ঋতু খুব মুস্কিলে পড়েছে দুর্গাপুজোর সাজগোজ নিয়ে। শাড়ি নিয়ে এখন আর কোনও সমস্যা নেই এদেশে। শ’খানেক আধুনিকা গৃহবধূর খোলা অন-লাইন দোকান আছে। তাঁতিদের থেকে সরাসরি কেনা দুর্ধৰ্ষ সব শাড়ির সম্ভার সেখানে বছরভর। কি সব ডিজাইন, মাথা ঘুরে যায় দেখলেই। সবারই ঘোরে নিশ্চই। তাইতো ওয়েব-স্টোরে শাড়ির ছবি পড়তে না পড়তেই উধাও। ডিজাইনার গয়নাও পাওয়া যায় তেমনই। অমন সব শাড়ি-গয়না সারা কলকাতা ঘুরে মরলেও সহজে পাওয়া যাবে না। আসল সমস্যা হচ্ছে যথাযথ ফিটিংয়ের ব্লাউস নিয়ে। শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউস পিস্ দেওয়া হয়। কিন্তু বানাবে কে! ইন্দ্রানী, নীলাঞ্জনা আরও কেউ কেউ পূজোর আগে কলকাতা যাচ্ছে বটে। কিছু আনার দরকার থাকলে বলতে বলেছে, তবু ব্লাউস বানিয়ে আনতে বলতে কেমন যেন বাধো বাধো লাগে। ওদেরও তো কত কাজ থাকে নিজেদের দু-তিন সপ্তাহের কলকাতা ট্রিপে। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে লিন্ডসে স্ট্রিটে গ্লোবের পাশে ফ্রেঞ্চে ব্লাউস বানাতে যাবার কথা মনে পড়ে। ফ্রেঞ্চের লো-কাট সব দুর্দান্ত ডিজাইন ছিল। মায়ের চোখ মটকানি উপেক্ষা করে সে সব অর্ডার দেওয়ার উত্তেজনায় আলাদা ছিল। সেই টেনশন শেষ হতো রাস্তার ধারা মনের সুখে মা-মেয়েতে আলুর টিকিয়া ফুচকা আর কুলফি-ফালুদা খেয়ে। তবে ফ্রেঞ্চ বড্ড টাইট টাইট ব্লাউস বানাতো। তখন পরতে তেমন অসুবিধে না হলেও এখন কি আর পরা যাবে সেসব !
শ্রাবণী, মুনমুন, পূর্বা, ডালিয়া, অনুরাধাও ভেবে ভেবে হয়রান। গড়িয়াহাটের বাহার টেলর নাকি সাদার্ন এভিনিউয়ের আকবর। কাকে দিয়ে বানানো যায় পূজোর শাড়ীর পিস্ থেকে ঠিকঠাক ফিটিং-এর ব্লাউস। গড়িয়াহাটের কিংবদন্তীর গলির বাহার বড্ড সময় চায়। দেশের আর বিদেশের খদ্দেরের হাতে থাকা সময়টা যে এক নয় বুঝতে চায় না। অথচ ঠিকঠাক ফিটিং হওয়াটা বড্ড দরকার। শরীরের মাপও এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে নেই। সপ্তাহান্তের পার্টিগুলো আছে। বন্ধুরা এক একজন রন্ধনে দ্রৌপদীর মতো পটিয়সী। প্রলোভন সামলাতে মনের জোর লাগে। তাই মাপ বাড়ে। আবার স্লিম কাউকে দেখে মনে জোর আনতে ইচ্ছে হয় মাঝেসাঝে। ব্যাস অমনি ডায়েট কন্ট্রোল। তাই শরীরের মাপের জোয়ার ভাটা লেগেই আছে। পুরোনো ব্লাউসগুলো হয় চেপে বসে নয় ঢলঢল করে। পুজোর জন্য তখনকার মতো সঠিক মাপের জামা বানাতেই হয় ফি-বছর।
ডেনভারের পূজা কমিটির প্রেসিডেন্ট পূজোর জায়গার খোঁজে হয়রান। যে হারে বাঙালির সংখ্যা বেড়েছে, আগের মতো কোনো স্কুলের অডিটোরিয়াম আর ক্যাফেটেরিয়া ভাড়া করে স্থান সংকুলান করা সম্ভব হচ্ছে না আর সবার জন্য। এবার বুঝি কনভেনশন সেন্টারের মতো বড় জায়গা নিতে হবে। দেশ থেকে বানানো দুর্গাপুজোর মূর্তিও নয় নয় করে বছর সাতেকের পুরনো হতে চলল। এবার একসেট নতুন মূর্তি বানানো হচ্ছে। তার জন্য টাকা তোলার কাজ আছে। পুরনো মূর্তি নেবার লোকও জোগাড় হয়ে গেছে। আমেরিকার কোণে কোণে ছোট ছোট শহরে বাস করতে আসা মানুষজনের তৈরি ছোট পূজো কমিটির অত পয়সা নেই। তাদেরই একদল কিনে নেবে ডেনভার এর পুরনো মূর্তি। না কিনতে পারলে এমনিই দিয়ে দেওয়া হবে। কারও কাজে লাগলে লাগুক। এই রিসাইকেল, রিইউজের যুগে পরিবেশবান্ধব বেশ একখানা কাজ করা হবে।
সমস্যার কি আর শেষ আছে। পূজো মানে তো স্রেফ পূজোই না। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করার আছে। সভ্য সদস্যদের নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা আছে। সেখানে সবার ছেলেমেয়ে বা ইচ্ছুক পরিবারের সদস্যদের সুযোগ দিতে হয়। তা না হলেই মন কষাকষি। তার উপরে কলকাতা থেকে সবার মনের মতো গানের শিল্পী আনার ব্যাবস্থা করার আছে। নতুন আসা ছেলে ছোকরারা চায় তাদের পছন্দের অনুপম, রূপম, রূপঙ্কর বা বাংলা ব্যান্ড আসুক। বয়স্করা চান এমন কেউ আসুক যে পুরোনো দিনের সোনালি বাংলা গানগুলো গাইতে পারে - সন্ধ্যা, হেমন্ত, শ্যামল, মানবেন্দ্র, মান্না, প্রতিমা, মাধুরী, নির্মলাদের মন কেমন করা গান। মাঝ বয়সিরা সবেতেই সন্দেহবাতিক। অফিসে যা কাজের চাপ হয়তো দুদিন আসতে পারবে না পুজোয়। তবু একদিন অন্তত আসতে হবেই, না হলে বউয়ের মুখ ভার। প্রেসিডেন্টের চিন্তার কথাটা কেউ বোঝে না। সমস্ত ক্ষমতাধারী পদের পেছন পেছন আসে দায়িত্ব। কেউ বুঝল না সে কথা।
মিলনদা, বিজয়দা, ডক্টর দেব, মানিকদা, রথীনদা, হেমন্তদাদের এদেশে আসা হয়ে গেল কারও ৪০ তো কারও ৫০ বছর। ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেছে সেই কবে। তাদের আলাদা সংসার, অন্য শহরে হাজার হাজার মাইল দূরে। আমেরিকা তো আর পুচকে দেশ নয়। পুজোয় ছেলে মেয়েদের কাছে যাবে নাকি ডেনভারের পুজোয় আসবে ভেবে কুল কিনারা পান না। হাজার হোক নিজেদের হাতে শুরু করেছিলেন এ পুজো। সেই থার্মোকল কেটে নিজেদের হাতে বানানো মূর্তি থেকে আজ কুমোরটুলি থেকে আনা মূর্তিতে পুজো হচ্ছে এখন। দেখতে দেখতে কত কী বদলে গেল। ছেলে মেয়েদের অনেকে এদেশের ছেলেমেয়েদের বিয়ে করেছে। ওদের কাছে দুর্গাপুজো হয়তো একই রকম অর্থ বহন করে না। ওঁদের স্ত্রীরা বড্ড দোটানায়। শরীরও আজকাল ভাল থাকে না সব সময়। পুজোয় আসতে পারা নিয়ে নিশ্চিন্ত নন এখনও।
এক একজনের সমস্যা এক এক রকম । মাঝবয়সীদের ছেলেমেয়েরা কলেজে যাবার সময় হয়ে এসেছে। পড়াশুনোর চাপ, কলেজ এডমিশনের চাপ। সে সব নিয়ে ব্যাস্ত। দু-তিন ধরে পূজোয় এলে অনেকটা সময় নষ্ট। ওদের বন্ধুবান্ধবরাও ছিটকে গেছে এদিক সেদিক। পূজোয় এসে একাএকা চুপ চাপ বসে থাকা উপভোগ করে না কেউ।
দেশ থেকে সদ্য আসা নবীনদের দল, এখনো সবাইকে চিনে উঠতে পারে নি তেমন করে। তাই স্বভাবতই লাজুক। পূজোয় আসা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ। যদি কেউ একটু আলাপ পরিচয় করিয়ে দেয় এখানকার বাঙালিদের সঙ্গে, তবে পূজোয় আসতে পারে। সবচেয়ে খুশি নবীন যুবক যুবতীর দল যারা হয় সদ্য এদেশে সংসার পেতেছে অথবা ছোট শিশুদের মা-বাবা হয়েছে। এখনো তেমন করে সংসার আর চাকরির জোয়ালে জুতে যেতে হয় নি। জীবন তাই সুন্দর আর ঝলমলে।
আরও পড়ুন: জার্মানির কোলোনে বিবিধের মাঝে মহান মিলনের এবার ২৮ বছর
তবু পূজো আসে বছরের পর বছর। ক্রমশ: আরও একাকী হয়ে উঠে প্রবীণদের দুদিনের জন্য ফাঁকা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আবার দেখা করতে সাধ জাগে। সদ্য আগতরা জড়তা কাটিয়ে উঠতে চায়। মাঝবয়সীরা সংসারের জোয়াল খুলে ফেলতে মরিয়া হয়ে ওঠে। সপ্তাহান্তের দুটো মাত্র দিনের জন্য, ফেলে আসা দেশের স্মৃতি রোমন্থন করে বাঙালীর সব থেকে বড় উৎসব শারোদোৎসবে মেতে উঠ্তে চায় সবাই। প্রতিবারের মতো এবারেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy