আর কয়ের দিন পরেই পুজো। চারদিক জেগে উঠবে ঢাকের আওয়াজে।বাতাসে পুজোর আমেজ। আর পুজো মানেই মাঠ-ভরা কাশফুলের সঙ্গে ভোরের শিশির ছোঁয়া শিউলি। দোকানে দোকানে জামাকাপড় কেনার হিড়িক। পুজো মানেই নতুন জামার গন্ধ। পুজো মানেই পুরনো সব কিছুকেই যেন নতুন করে পাওয়া।
মা আসছেন, তাই বাঙালির মনে উৎসবের আনন্দ। ওই পাঁচটা দিন শুধুই খাওয়াদাওয়া আর কাছের মানুষদের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠা। তাই উৎসবপ্রিয় বাঙালি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, সারা বছর ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে তারা পুজোর এই দিনগুলোর জন্য।
গত পাঁচ বছর ধরে রয়েছি আমেরিকায়। ডালাসের প্লেন শহরে। দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে আজ বাঙালির দুর্গাপুজো বিদেশের মাটিতেও। তবে দিন, ক্ষণ, তিথি, নক্ষত্র মেনে নয়। আমাদের পুজো হয় সপ্তাহান্তে। শুক্রবার ষষ্ঠী, রবিবার দশমী। মাঝে শনিবার সপ্তমী-অষ্টমী একসঙ্গে। রবিবার দশমীর দিনেই নবমী। শনিবার অনেক সকাল থেকে আমরা হাজির হই সপ্তমী আর অষ্টমী পুজোর অঞ্জলিদেওয়ার জন্য। তার পর মায়ের প্রসাদ খেয়ে, পুরো দিনটা সকলের সঙ্গে কাটাই। দুপুরে মায়ের অষ্টমী পুজোর খিচুড়ি ভোগও লুচির মতো বিশেষ খাবার যেমন থাকে, তেমনইসন্ধেবেলা আয়োজিতহয়বিশিষ্ট তারকাদের গান, স্থানীয় শিল্পীদের নাচ আরনাটক।
আরও পড়ুন: ক্লিভল্যান্ডে দুর্গাপুজো হয় চার্চে
পর দিন আমরা সকাল সকাল দুর্গামণ্ডপে হাজির থেকে নবমীর পর বিজয়ার পুজো সেরে মাকে সিঁদুর পরিয়ে মেতে উঠি সিঁদুরখেলায়। অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা ঢাকির ভূমিকায় থাকেন,সঙ্গে চলে ধুনুচি নাচ। এ ভাবে মায়ের বিদায় জানানো হয়, ‘আসছে বছর, আবার হবে’ বলে।
ডালাসের বিশেষ কয়েকটি পুজোর মধ্যে রয়েছে ‘আন্তরিক’, ‘ডিএফডাব্লিউ’ আর ‘রিদিম’-এর মতো বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজন। এ ছাড়া আরও ছোট ছোট পুজো হয়। তবে ডালাসের বেশির ভাগ বাঙালিই এই তিনটি পুজোতে অংশ নেন। বিশিষ্ট শিল্পীরাও যোগ দেন এই পুজোগুলিতে। যেমন এবারে ‘আন্তরিক’-এর ডাকে সাড়া দিয়ে কলকাতা থেকে আসছেন শ্রীকান্ত আচার্য,সোহিনী-রাহুল এবং রূপঙ্কর। ডিএফ ডাবলু অ্যাসোসিয়েশনের তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশের নোবেল, ইমন এবং সৌরেন্দ্র-সৌম্যজিৎ। অন্যদিকে রিদিমের পুজোর সন্ধেগুলি জমাতে আসছেন সুপ্রতীক ভট্টাচার্য, মনোময় ভট্টাচার্য, শ্রীজাত-র মতো তারকারা। গান-বাজনা, খাওয়া-দাওয়া সব কিছু নিয়ে হয়ে উঠবে এক মনোরম সন্ধ্যা।
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন। প্রবাসী বাঙালি হওয়ার ফলে সেই তেরো পার্বনের সবটুকুর আঁচ না পেলেও, শারদোৎসব থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি পশ্চিমী দুনিয়া।আর পাঁচটা প্রবাসী বাঙালিদের মতো আমাদের একটু মন খারাপ হলেও মানিয়ে নিয়েছি সাত-সমুদ্র তেরো নদীর পারের এই সপ্তাহন্তের পুজোয়। বাঙালিদের কাছে পুজো মানেই কলকাতা। আর কলকাতার পুজো মানে পাড়ার প্যান্ডেলে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুচকা, বিরিয়ানি, ঘুগনি। সে এক অন্য পুজোর স্বাদ। এখানেমায়ের আগমনীর জানান দেয় না মহালয়া।ঘড়ি মিলিয়ে চারটেরসময় রেডিয়োতে বেজে ওঠে না বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। শুনতে পাওয়া যায় না‘বাজলো তোমার আলোর বেনু’। তবুও আমরা হার মানতে রাজি নই। তাই মহালয়ার দিন সকালে রেডিয়োতে নয়, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বাজে ইউটিউবে।
আরও পড়ুন: মরুভূমিতে পদ্ম ফোটে মায়ের আগমনে
দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর সব বন্দোবস্ত করলেও আমরা যারা দুধের সাধ জানি, তাঁদের কী আর ঘোলে আশ মেটে। তাই তফাৎ থাকেই। আর সেই তফাৎ হলগন্ধে। পুজোর গন্ধটা এই ডালাসে বসে একেবারেই পাইনা। এখানে নেই বাঁশের খুঁটির প্যান্ডেল,হল ভাড়া করে পুজো হয়।নেই থিম পুজোর আকর্ষণও। দেশের মতো প্রত্যেক বছরে মায়ের নতুন প্রতিমা সাগরপারে দেশে আনা হয়না। পুজো হয় একই প্রতিমাতে। পাঁচ বছর একই প্রতিমাতে পুজো করে নতুন প্রতিমা আনা হয়। তাই প্রতিমা বিসর্জনের মজাটাও পাইনা আমরা। পুজো শেষে প্রতিমা সংরক্ষণ করে রাখা হয় কারওর বাড়িতে অথবা কোনও বিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে। এখানের পুজোতে অংশ নেওয়া হয়টিকিট কেটে। একটা নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী পুজো শুরু হয় এবং পুজো শেষ করা হয়। একটা পুজোতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। তাই নেই রাত জেগে ঠাকুর দেখার আনন্দ,পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঠাকুর দেখার সুযোগ। যাই হোক এই সব কিছু ভুলে আমরা সাগরপারের বাঙালিরা দুধের সাধ একরকম ঘোলেই মেটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy