সাত বছর আগে যবে কলকাতা ছেড়েছি তবে থেকে পুজো মানে আমার কাছে কোলনের কোরওয়াইলার। জার্মান শরতের হিমের পরশ কাটিয়ে পুজোর কমিউনিটি হলে ঢুকলে কারও মনে হবে না আমরা সাত সমুদ্র পারে আছি। কোলনের পুজো এবার ২৮ বছরে পড়ল। ইউরোপের সবচেয়ে পুরনো আর বড় পুজোর মধ্যে এটি অন্যতম। দুর্গাপুজো জার্মানিতে ফ্রাঙ্কফুর্ট, বার্লিন, মিউনিখ, ডুসেলডর্ফ এত ষ্টুটগার্টে হলেও লন্ডন বাদে পুজোতে কোলোনের মতো জনসমাগম সারা ইউরোপে খুঁজে পাওয়া কঠিন। রূঢ় অঞ্চলের বাঙালিরা ছাড়াও সারা জার্মানির, ওর কাছের বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডস থেকেও বহু ভারতীয় এবং ইউরোপীয় অনুরাগীরা এই পুজোতে আসেন। গত বছর শুধু নবমী রাতেই প্রায় হাজার লোকের সমাগম হয়েছিল। বিকেলবেলায় হলের ভেতর ছড়ানো ছিটানো আড্ডায় ম্যাডক্সের আমেজ ফিরে আসে। সারা সপ্তাহ ছুটি নেওয়ার সুযোগ তো সকলের হয় না, তাও কর্মকর্তারা প্রতিদিন সকাল থেকেই পুজোতে থাকেন। সবাই মিলে সকাল থেকে চলতে থাকে পুজো আর সারাদিনের খাওয়াদাওয়ার প্রস্তুতি। বাকি আমরা চাকরিজীবীরা যেদিন ছুটি পাই সেদিন সকালে আর না হলে দিনশেষে জলদি অফিস থেকে ছুট। জামা কাপড় পাল্টে ঠ্যালাঠেলি করে বিকেলের অঞ্জলি দিয়ে তবে শান্তি। তারপরে দূরে থাকা বন্ধুদের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া, নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচয় আর বাঙালির চিরকালীন মিষ্টি। অব্যক্ত পুজোর রোম্যান্স প্রবাসে করার মজাই আলাদা। আশা, আরতি, মান্না, হেমন্তের গানে ক’দিনের জন্য কোল্ডপ্লে আর ড্রেকের প্লেলিস্ট ঢাকা পড়ে যায়। পাট ভাঙা পাঞ্জাবি, জামদানি, সালোয়ার আর বেনারসির ভিড় সন্ধ্যায় মিশে যায় ধুনুচির ধোঁয়া। মায়ের সামনে সেলফি, গ্রূপফির মতোই মঞ্চের ওপর কাড়াকাড়ি পরে যায় কাঁসরঘন্টা বাজানো নিয়ে। ছোট বড় আনাড়ি হাতের ঢাক বাজনার সাথে সন্ধিপুজোর মন্ত্রপাঠে বেজির্করাট হাউসের হল ক’দিনের জন্য মায়ের মন্দির হয়ে ওঠে। সিঁদুর খেলা আর নিরঞ্জনের পর মা ফিরে যান ভারত সমিতির ঘরে পরের বছর অবধি।
এবারে যদিও পুজো পুরোটাই সপ্তাহের মধ্যে পড়েছে কিন্তু তার জন্য অনুষ্ঠানসূচিতে কোনও প্ৰভাব পড়েনি। প্রতি বারের মতো এ বারেও তিথি মেনে সোমবার বোধন হবে। বুধবার অষ্টমীর সকালে অঞ্জলির পরে সবার অপেক্ষা থাকবে ভোগের প্রসাদ আর খিচুড়ির জন্য। লুচি তরকারির সঙ্গে বিলি হবে চালকলা আর মাখা সন্দেশ। এখানে প্রতিদিন দুপুরে এবং সন্ধেবেলায় সকল দর্শনার্থীর জন্য বাঙালি খাবারের আয়োজন থাকে। আর মাঝেমধ্যে চা চানাচুর, তেলেভাজা তো লেগেই আছে। আমাদের এখনকার প্রতিমা তিন বছর আগে কুমোরটুলি থেকে আসে, পাঁচচালা সাবেকি ডাকের সাজের প্রতিমা, মঞ্চসজ্জা মধুবনী পটচিত্রে আঁকা । এবছরও সপ্তমী থেকে দশমী সব দিন সন্ধেয় থাকছে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কচিকাঁচাদের জার্মান উচ্চারণে বীরপুরুষ বা সুকুমার রায় শুনতে ভীষণ কিউট। পুজোর আয়োজক ভারত সমিতির সদস্যরা ছাড়াও এবছর নৃত্যশিল্পীরা আসবেন আইন্ডহোভেন এবং সুদূর কলকাতা থেকেও। বাংলা আর জার্মানে মেশানো ধারাভাষ্যের মাঝে গাওয়া হয় আগমনী আর স্বর্ণযুগের গান। তাছাড়াও থাকবে বলিউডের নাচ, ভরতনাট্যম ও কৃষকনৃত্য। দুই মাস আগে থেকে চলছে তার মহড়া। এই পুজোতে শুধু বাঙালিয়ানাই নয়, উদযাপিত হয় দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্কৃতিও। প্রাদেশিক নাচ, শাস্ত্রীয় এবং যন্ত্রসংগীতের অনুষ্ঠানে এখানে কেবল ভারতীয় নয়, স্থানীয় জার্মান এবং অন্য ইউরোপিয়ানদের প্রতিভাও দেখার মতো। কোনো টিকিট বা প্রি-রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই সকলের জন্য অবারিত দ্বারের এই পুজো কতিপয় স্পনসর, আগত দর্শনার্থীদের অনুদান এবং আয়োজকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রত্যেক বছর সম্ভব হয়ে আসছে ।
আরও পড়ুন: বাহরিনের ২৫ বছর দুর্গাপুজোয় সমাগম প্রবাসী বহু ভারতীয়ের
আমরা যারা দেশ থেকে দূরে সারা বছর প্রবাসে থাকি তাদের কাছে এই পুজো শুধু একটা অনুষ্ঠান নয়, একটা চেষ্টা বাংলার জন্য আমাদের আবেগ আর ভালবাসাকে নিজেদের ভিতর বাঁচিয়ে রাখার আর সেই পরম্পরা আমাদের পরের প্রজন্ম আর অন্য দেশ, ভাষা আর সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার। কলকাতা না যাবার আফসোস এখন আর নেই, বরং এখানকার আন্তরিকতা আর দায়িত্বের বন্ধন ছেড়ে এই সময় দেশে যাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান দর্শনার্থীদের জন্য আমাদের পুজোর হল কখনও ছোট লাগে। কিন্তু এই সব সাময়িক সমস্যা আমাদের ভক্তি আর উচ্ছ্বাসের সামনে তুচ্ছ। মায়ের আশীর্বাদের ছায়ায় বিবিধের মাঝে এই মহান মিলনে এবার আমরা অপেক্ষায় রইলাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy