তেরো বছর আগে এই জায়গাটাতেই দিনভর মানুষের ছুটোছুটি লেগে থাকত। আজ সেখানে শুধুই বিষণ্ণতা।
২০০১ এর ১১ সেপ্টেম্বর। ওই একটা দিন কেবল হাজার হাজার মানুষের জীবনটাই শুধু বদলে দেয়নি, কেমন যেন পাল্টে দিয়েছিল গোটা আমেরিকাকেই। আকাশ চেরা টুইন টাওয়ার এক লহমায় গ্রাউন্ড জিরো। দগদগে ঘা-এর মতো ক্ষতগুলোকেই পরম যত্নে সাজিয়ে গুছিয়ে সেই গ্রাউন্ড জিরোয় এ বার খুলল সংগ্রহশালা। গত বৃহস্পতিবার ‘সেপ্টেম্বর ১১ স্মৃতি সংগ্রহশালা’র উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তবে অনুষ্ঠানে যোগ দেননি তাঁর পূর্বসূরি জর্জ বুশ। সেখানে গেলে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বেন, এই যুক্তিতে সরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। এ নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। তবে সাধারণের জন্য সংগ্রহশালার দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে ২১ তারিখ।
যদিও গোড়া থেকেই বাধা এসেছে একের পর এক। কখনও রাগের মাথায় দু’চার কথা শুনিয়েছেন আত্মীয়হারা মানুষগুলো। কেউ আবার প্রকল্পটার উদ্দেশ্য শুনেই ভ্রু কুঁচকেছেন। আর্থিক টানাপড়েন থেকে স্যান্ডির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও বাদ সেধেছে পদে পদে। তা-ও একটু একটু করে এগিয়েছে কাজ।
প্রকল্পটি বরাত পেয়েছিল নরওয়ের এক সংস্থা। সামনে গ্রানাইটের তৈরি দু’টো বিশাল বেসিন। উপচে পড়া জলের ধারা যেন ধুইয়ে দিচ্ছে টুইন টাওয়ার ভিত। বাকি গ্যালারির বেশিটাই (প্রায় দশ হাজার বর্গফুট এলাকা) মাটির থেকে ৭০ ফুট নীচে।
আলো-আঁধারিতে ঘেরা চোখের সামনেই যেন এক জীবন্ত ধ্বংসস্তূপ। ভিতরে ঢুকতেই নজরে পড়বে দু’টো বিশালকার থাম। এককালে তার গায়ে ছিল অ্যালুমিনিয়ামের আস্তরণ। উত্তর দিকের টাওয়ারে অন্যতম এই স্তম্ভে পলেস্তরা খসে এখন শুধুই জংয়ের আঁচড়। যে সিঁড়ি দিয়ে প্রাণভয়ে দৌড়ে নেমেছিলেন কত শত মানুষ, সেই ভাঙাচোরা সিঁড়ির কিছুটাও রাখা আছে সযন্তে। টুইন টাওয়ার ধসে পড়ার ছবি থেকে পরের দিনের খবরের কাগজের শিরোনাম, ধুলোবালি মাখা জামাকাপড় থেকে উদ্ধারকর্মীর হেলমেট কী নেই সংগ্রহে! গ্যালারিরই এক জায়গায় ঘিরে রাখা নিউ ইয়র্কের দমকল বিভাগের একটা মই। লাল রঙের গাড়ির গায়ে হলুদ দিয়ে বড় বড় হরফে লেখা ‘ল্যাডার ৩’। গাড়ির পিছন দিকে অবশ্য রঙের আখর নেই মোটেই। দুমড়ে মুচড়ে মইটাই এমন ভাবে বেঁকে গিয়েছে যে অ্যালুমিনিয়ামের পাত ছাড়া বোঝা যায় না কিছুই। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ভেঙে পড়ার পর স্বজনহারারা যে কার্ড, স্মারক রেখে যেতেন সে সবই তুলে এনে রাখা হয়েছে একটা দেওয়াল জুড়ে। ছুটোছুটি, চিৎকার চেঁচামেচির অডিও রেকর্ড থেকে মায় ভিডিও রেকর্ডিং সবই আপাতত দর্শকের অপেক্ষায়।
সংগ্রহশালারই একটা প্রান্তে রাখা বেশ কিছু দেহাবশেষ। পুড়ে যাওয়া প্রিয়জনের দেহ যেমন অনেকে চিনতে পারেননি, তেমনি অনেকের খোঁজে আজ পর্যন্ত আসেননি এক জনও। সংগ্রহশালায় এঁদের রাখা নিয়ে আপত্তিও জানিয়েছিলেন অনেকে।
পোশাক থেকে গলার স্বর, সংগ্রহশালার পরতে পরতে জড়িয়ে আছেন জঙ্গি হানায় নিহত ২,৯৮৩ জন। মানুষগুলোই যা কেবল ধরাছোঁয়ার বাইরে।