সোনালি (ছবি: পারিবারিক সৌজন্যে প্রাপ্ত)
সুতোটা ছেঁড়েনি ছ’দশকেও।
ছ’দশক আগের সেই সময়ে যদিও দেশময় ঢি-ঢি পড়ে গিয়েছিল। তখনকার সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটির তুলনা হয়েছিল রাবণের সীতা-হরণের সঙ্গে। স্বামী, ছ’বছরের পুত্র, পরিবার-পরিজন সবাইকে ছেড়ে এক শ্যামাঙ্গিনী বিদূষী বাঙালি নারী যখন তাঁর বিবাহিত প্রেমিকের সঙ্গে ইতালি পাড়ি দিচ্ছেন। প্রেমিকটি ‘নিও-রিয়ালিজমের জনক’ বলে খ্যাত চলচ্চিত্রকার রর্বেতো রোসেলিনি। আর সব ছেড়ে তাঁর সঙ্গে চলে যাওয়া বাঙালি মেয়েটি সোনালি দাশগুপ্ত, পরবর্তী কালে বিবাহসূত্রে সোনালি রোসেলিনি।
শনিবার, ভারতীয় সময় ভোর সাড়ে ছ’টায় রোমে প্রয়াত হন সোনালি। বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। সোনালির প্রাক্তন স্বামী, পরিচালক হরিসাধন দাশগুপ্ত আগেই মারা গিয়েছেন। রোসেলিনিও দীর্ঘদিন প্রয়াত। কিন্তু পরবর্তী জীবনে কলকাতার পরিজনদের সঙ্গে সোনালি ও তাঁর রোমের আত্মীয়দের সম্মানবোধ বা হৃদ্যতায় ঘাটতি হয়নি।
পরিবার সূত্রের খবর, সপ্তাহ দুয়েক আগে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ধাক্কাটা আর সামলাতে পারেননি সোনালি। শেষ দিকটায় বাড়িতে একা থাকতেন। পড়ে গিয়েও চোট পেয়েছিলেন। পরে এক বন্ধু হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু সোনালির হৃদ্যন্ত্র, মস্তিষ্ক, স্নায়ুগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। মাঝে একটু সুস্থ হলেও শেষরক্ষা হয়নি। পারিবারিক সূত্রে খবর, রোমেই সম্ভবত তাঁর শেষকৃত্য হবে। তবে আইনজীবীর জন্য একটি চিঠি রেখে গিয়েছেন সোনালি। শেষকৃত্যের আগে সেটি খোলা হতে পারে। কলকাতা থেকে শেষকৃত্যে কেউ যাচ্ছেন না বলেই খবর।
রোমে সোনালির বুটিকে ইন্দিরা গাঁধী।
হরিসাধন-সোনালির বড় ছেলে, কলকাতার পরিচালক রাজা দাশগুপ্ত। তিনি এ দেশে বাবার কাছেই থেকে যান। ছোট ছেলে জিল ওরফে অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন সোনালি। ছ’বছর আগে জিল মারা যান। সোনালিও তার পর থেকে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন। সোনালি-রোসেলিনির মেয়ে রাফায়েলা, রোসেলিনি ও তাঁর আগের পক্ষের স্ত্রী তথা হলিউড কাঁপানো নায়িকা ইনগ্রিড বার্গম্যানের কন্যা ইসাবেলা এঁদের সঙ্গে আপন ভাই-বোনের মতোই সম্পর্ক রাজার।
মায়ের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর ইসাবেলার কাছ থেকে একটি ই-মেল পান রাজা। ইসাবেলা তাতে লিখেছেন, স্নেহময়ী সৎমাকে নিয়ে তিনি কতটা গর্বিত। লিখেছেন, ষাট-সত্তরের দশকে রোমের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো শাড়ি-পরা অদ্ভুত সুন্দর (এক্সোটিক) সোনালির কথা “সব সময়ে ভেবেছি, তোমায় চিরতরে ছেড়ে আসার সময়ে ওঁর কেমন লেগেছিল।” অথচ পরবর্তী জীবনে সোনালির থেকেও আলাদা হয়ে যান রোসেলিনি। শোনা যায়, ফের অন্য এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু সোনালির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধন রয়ে যায় সব ক’টি সন্তানের।
প্রথম স্বামী হরিসাধন দাশগুপ্তর সঙ্গে।
সেই কথাই বলছিলেন সোনালি-হরিসাধনের নাতি, তরুণ পরিচালক বিরসা দাশগুপ্ত। কখনও ‘ঠাম্মা’কে দেখেননি। কিন্তু গল্প শুনেছেন। দাদুন (হরিসাধন) বিরসাকে বলেছিলেন, রোমে ঠাম্মা তাঁদের বৃহত্তর পরিবারের সঙ্গে আছেন। বিরসার কথায়, “ঠাম্মা কী করে ছেলেকে ছেড়ে গেলেন, তা নিয়ে কত লোকে কত কথা বলে! কিন্তু কেউ তো বলে না যে, রোসেলিনি ও ইনগ্রিডের আগের পক্ষের সন্তানদেরও মানুষ করেছেন ঠাম্মা।” বিরসার মা চৈতালি দাশগুপ্ত জানালেন, তাঁর মা-ও বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন যখন তাঁর পনেরো বছর বয়স। একই রকম প্রশ্নের মুখে তিনিও পড়েছেন। তাই রাজার মা-কে নিয়ে তাঁর আলাদা কোনও জিজ্ঞাস্য ছিল না। তাঁর কথায়, “ওঁর জীবনে যা হয়েছে, সেটা ওঁর নিজস্ব ব্যাপার! সব খুঁটিনাটি না-জেনে আমি সমালোচনা করতে পারি না!”
১৯৫৭ সালে অবশ্য এত সহজে কথাগুলো বলা যেত না। জওহরলাল নেহরুর ডাকেই ভারত নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করতে এসেছিলেন রোসেলিনি। পুরনো কিছু সূত্র ও নথি বলছে, ওই সময়েই সোনালিকে সঙ্গে নিয়ে মুম্বইয়ে রোসেলিনির সঙ্গে দেখা করেন হরিসাধন। তাঁর উৎসাহেই রোসেলিনির সহায়তায় যুক্ত হন সোনালি।
রোসেলিনি পরে বলেছেন, ভারতকে তিনি চিনেছিলেন সোনালির চোখ দিয়েই। রোসেলিনির ছবির চিত্রগ্রাহক অল্ডো তোন্তির সাক্ষাৎকারে উদ্ধৃত আছে, সেই সময়েই দু’জনের সম্পর্ক দানা বাঁধছিল। ’৫৭ সালের মে-জুনেই মুম্বইয়ের ফিল্মি পত্রিকায় রোসেলিনি-সোনালি নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। তাতে অস্বস্তিতে পড়েন নেহরুও। আবার ইনগ্রিড বার্গম্যানের তৎকালীন স্বামী রোসেলিনির এই ‘স্খলন’ নিয়ে আমেরিকাতেও হইচই হয়। এই আবহেই অগস্টে রোসেলিনির সঙ্গে দেশ ছাড়েন সোনালি।
শান্তিনিকেতনের কলাভবনে পড়ার সময় থেকেই ইন্দিরা গাঁধীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন সোনালি। নেহরু তাঁকে স্নেহ করতেন। শোনা যায়, এই যোগাযোগের সুবাদেই পাসপোর্ট জোগাড় করেছিলেন সোনালি। পরবর্তী কালে রোমে সোনালির বুটিকেও দেখা গিয়েছে ইন্দিরাকে। এক সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তাঁত ও হস্তশিল্প রফতানি নিগমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সোনালি। লন্ডন ও রোমের দু’টি সরকারি স্টলের জন্য শিল্পসামগ্রী বাছাই করতে তখন প্রত্যেক গ্রীষ্ম আর শীতে দিল্লি আসতেন তিনি। রাজা তখন দিল্লিতেই পড়ছেন। তখন মায়ের সঙ্গে বেশ কয়েক বার দেখা হয়েছে তাঁর।
অনেকদিন পর। বড় ছেলে রাজা ও পুত্রবধূ চৈতালির সঙ্গে।
কিন্তু মা চলে যাওয়ার পর প্রথম দেখা? সেটা আরও আগে। রাজা তখন ক্যালকাটা বয়েজে ক্লাস নাইনে পড়েন। হস্টেলে থাকেন। কোনও একটা কাজে কলকাতায় এসে বড় ছেলেকে দেখতে যান সোনালি। রাজার কথায়, “শুনেছিলাম, স্কুলকে বলা হয়েছিল, মা এলে দেখা করতে না দিতে। তবে দেখা হয়েছিল। মনে হয় না বাবা এমন কোনও নির্দেশ দিয়েছিলেন।”
কেন? রাজা জানালেন, বাবা-ই এক দিন হাতে প্লেনের টিকিট দিয়ে তাঁকে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পাঠিয়েছিলেন। প্রায় দু’মাস রোমে ছিলেন। আর দু’বছর আগে শেষ বার রোমেই চৈতালি-রাজার সঙ্গে দেখা হয় সোনালির। চলে আসার সময়ে দরজা অবধি এগিয়েও দিয়েছিলেন। কোনও দিন রাজা জানতে চাননি, কেন চলে গিয়েছিলেন মা। কিন্তু সোনালি-রোসেলিনি নিয়ে গালগল্পে তাঁর আপত্তি। এ নিয়ে দিলীপ পড়গাঁওকরের বহুল আলোচিত বই ‘আন্ডার হার স্পেল’ও ততটা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলেই রাজার অভিমত।
মণি কউল, অনুরাগ কাশ্যপরা ছবি করার কথা ভেবেছিলেন সোনালির জীবন নিয়ে। সোনালিও নাকি কয়েক বার ভেবেছেন জীবন নিয়ে লেখার কথা। বিশ্বাস করতেন, রোসেলিনির সঙ্গে পালিয়ে যাওয়াটাই তাঁর জীবনের একমাত্র প্রধান ঘটনা নয়।
সোনালির কাছে বড় হওয়া, ইনগ্রিড-রোসেলিনির মেয়ে ইসাবেলার সদ্য পাঠানো ই-মেলে রাজা ও তাঁর পরিবারের জন্য আন্তরিক আদরের স্পর্শ। তিনি লিখছেন, “এটা ভেবে ভাল লাগে, অপ্রত্যাশিত, অদ্ভুত ঘটনাক্রমের সূত্রে যোগাযোগ হলেও আমাদের মধ্যে সুসম্পর্কই থেকেছে। অনেক আদর নিও। ইতি তোমার ‘বোন’... ইসাবেলা।”
সিনেমা হয়তো সত্যিই হার মানে সোনালির জীবননাট্যের কাছে। যে নাটকের শেষ অঙ্কটা রইল একেবারেই জটিলতাবিহীন। স্নিগ্ধ ও সহজ।