শান্তি কামনায়। বৃহস্পতিবার পেশোয়ারে।
বাঁচতে চাইলে হাত তোলো। জঙ্গিদের নির্দেশ শুনে ঝটপট হাত তুলেছিল পড়ুয়ারা। তাদের মধ্যে আট জনকে বেছে নেয় দুই বন্দুকবাজ। তবে মুক্তি দেয়নি। বরং ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি চালিয়েছিল ছোট্ট শরীরগুলোতে। চোখের সামনে বন্ধুদের লুটিয়ে পড়তে দেখেছিল শাহনওয়াজ খান। সে বর্ণনা দিতে গিয়ে বৃহস্পতিবারও কেঁপে উঠছে পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলের ওই ছাত্র। তার কাঁধে দু’টো গুলির ক্ষত। যদিও সে যন্ত্রণা ফিকে হয়ে গিয়েছে মঙ্গলবারের অভিজ্ঞতার কাছে। বন্ধুদের নিথর দেহগুলো কিছুতেই ভুলতে পারছে না কিশোর!
প্রথম দিকে যখন গুলির আওয়াজ কানে আসে, তখন তাকে সেনা মহড়া ভেবেছিলেন শাহনওয়াজদের ক্লাস টিচার। কিন্তু শব্দটা বাড়তে থাকলে দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিতে বাধ্য হন তিনি। তার পরই আতঙ্কিত চোখমুখ নিয়ে দৌড়ে ক্লাসরুমে ফিরে আসেন। দরজাও বন্ধ করার চেষ্টা করেন। পারেননি। লাথি মেরে দরজা খুলে ক্লাসরুমে ঢুকে পড়েছিল দুই বন্দুকবাজ। তার পরেই আসে হাত তোলার নির্দেশ। চলতে থাকে শিশুমেধ। শাহনওয়াজ জানাচ্ছে, গুলি চালাতে চালাতে জঙ্গিদের এক জন ক্লাস টিচারকে বলছিল, “প্রিয়জন মারা গেলে কেমন লাগে দেখো। আমাদের কাছের মানুষগুলোকেও এ ভাবেই মারা হচ্ছে।” এক বার চেয়ার থেকে উঠে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ক্লাস টিচার। সঙ্গে সঙ্গে ধেয়ে আসে হুমকি। হাসপাতালে শুয়ে এখনও মাঝে মধ্যেই ডুকরে কেঁদে উঠছেন বছর ছেচল্লিশের শিক্ষক। এক বার অস্ফুটে বললেন, “সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না।”
শাহনওয়াজ জানিয়েছে, প্রথম দফা হামলার ঘোর কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় হামলার তোড়জোড় শুরু করেছিল জঙ্গিরা। ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে যখন আট পড়ুয়ার দেহ পড়ে রয়েছে, তখন জঙ্গিরা জিজ্ঞাসা করে উঠল, “এর পরের আট জন কারা?” এ বার কোনও হাত ওঠেনি। জঙ্গিরা তখন টানাটানি শুরু করে। কিন্তু কোনও পড়ুয়াই নড়বে না। এ দিকে পাক সেনাবাহিনীর স্পেশ্যাল সার্ভিস গ্রুপের সদস্যরা তখন স্কুল চত্বরে পৌঁছে গিয়েছেন। জঙ্গিদের হাতেও বেশি সময় নেই। তাই এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে তারা। তখনই গুলিবিদ্ধ হয় শাহনওয়াজ।
পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে রক্তের দাগ মেলায়নি এখনও।
দু’দিন পরে বাবার সঙ্গে স্কুলে এসে শোকে-আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়েছে ছাত্রটি।
তবে পাক প্রশাসনের হিসেব মতো, মঙ্গলবার সবচেয়ে বেশি তাণ্ডব চলেছে স্কুলের অডিটোরিয়ামে। হামলার সময়ে সেখানে পড়ুয়াদের প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। সে সময় মঞ্চে যাঁরা ছিলেন, প্রথমে তাঁদের উপর গুলি চালায় জঙ্গিরা। তার পর প্রথম সারিতে যাঁরা বসেছিলেন, তাঁদের উপর হামলা করে। পাক সেনাবাহিনীর হিসেব মতো, সেখান থেকে অন্তত একশোরও বেশি দেহ উদ্ধার হয়েছে। এক সেনা অফিসারের বয়ানে, “চার দিকে দেহের স্তূপ। বেশির ভাগই নিথর। কারও কারও দেহে তখনও প্রাণ রয়েছে।...সর্বত্র রক্ত। এমন দৃশ্য না দেখলেই ভাল হতো।” চোখটা ছলছল করে ওঠে তাঁর।
একই কথা বলছে সৈয়দ বকির নকভি। সেনা স্কুলেরই নবম শ্রেণিতে পড়ত সে। ঘটনাচক্রে হামলার সময় অডিটোরিয়ামেই ছিল। তার বয়ানে, “আমাদের এক শিক্ষিকাকে দেখলাম চেয়ারের নীচে ঢোকার চেষ্টা করছেন। পারলেন না। পর পর তিনটি গুলি ঝাঁঝরা করে দিল তাঁকে।” তা দেখে বকিরও চেয়ারের তলায় ঢুকে পড়েছিল। প্রথমে তাকে খেয়াল করেনি জঙ্গিরা। পরে অবশ্য তাদের নজরে পড়ে যায় বকিরের উপরে। তার কপাল লক্ষ্য করে গুলিও ছুড়েছিল জঙ্গিরা। কিন্তু বকির মাথা ঘুরিয়ে নেওয়ায় বুলেট স্রেফ কপাল ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। পাক বাহিনীর চাপে আর দ্বিতীয় বার হামলার চাপ নেয়নি জঙ্গিরা। পালিয়ে গিয়ে প্রশাসনিক ভবনে ওঠে তারা। সেখান থেকেই চলে অন্তিম লড়াই। এক সময় পাঁচ জঙ্গিই নিজেকে উড়িয়ে দেয়। ফোনে ঠিক যেমনটা তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
সেই কথোপকথনের কিছুটা এ দিন প্রকাশিত হয়েছে পাক দৈনিকে। সেখান থেকেই জানা গিয়েছে, হামলা চলাকালীন কাউকে ফোন করে আবুজার নামে এক জঙ্গি প্রশ্ন করে, “অডিটোরিয়ামের সব বাচ্চা শেষ। এ বার কী করব?” ও পার থেকে উত্তর আসে, “পাক সেনাবাহিনীর জন্য অপেক্ষা করো। ওদের খতম করে তার পর নিজেদের উড়িয়ে দিও।” এ দিন পাক প্রশাসন জানিয়েছে, ফোনের ও পারের থাকা ব্যক্তিরা ছিল আফগানিস্তানে। এমনকী এই হামলার ছকও কষা হয়েছিল আফগানিস্তানে। এক অফিসারের কথায়, “তালিবানের ১৬ জন বড় মাপের নেতা ডিসেম্বরের গোড়ায় আফগানিস্তানে এক বৈঠকে এই হামলার ছক কষেছিল।” তাদের মধ্যে রয়েছে তালিবান প্রধান মোল্লা ফজলুল্লা, তার অনুচর শেখ খালিদ হক্কানি, হাফিজ সইদের (এই নেতা জামাদ উদ্ দাওয়া প্রধান নয়) মতো বড় মাপের নেতা। হামলার সময়ে ফোনে এদেরই কারও সঙ্গে কথা বলছিল আবুজার, অনুমান পাক প্রশাসনের। এ দিন বিষয়টি আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিকে জানানো হয়। পাক সেনার দাবি, ঘানি আশ্বাস দিয়েছেন পাকিস্তানে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য কোনও ভাবেই আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। তবে শুধু আফগানিস্তানের ভরসায় না থেকে এ দিন তালিবানের উপর হামলা জোরদার করেছে পাক বায়ুসেনা। তাদের দাবি, ওই হামলার জেরে পেশোয়ার লাগোয়া খাইবার উপজাতি এলাকায় বৃহস্পতিবারই ৫৭ জন জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে। এর পাশাপাশি সন্ত্রাসমূলক কাজে দোষী সাব্যস্ত ৫৫ জন জেলবন্দির ফাঁসির প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছে পাকিস্তান। এর মধ্যে ১৭ জনকে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই ফাঁসিতে ঝোলানো হতে পারে বলে খবর। সব মিলিয়ে সন্ত্রাসবাদ নিশ্চিহ্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছে পাক প্রশাসন। আক্ষেপ একটাই। এ তৎপরতা এল ১৩৩টি তাজা প্রাণের বিনিময়ে।
ছবি: এএফপি।
সিরিয়ায় উদ্ধার গণকবর
সংবাদ সংস্থা • দামাস্কাস
জঙ্গিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অপরাধে সিরিয়ায় অন্তত ২৩০ জনকে হত্যা করল আইএস। আজ, পূর্ব সিরিয়ার মরুপ্রান্তর সংলগ্ন দেইর আল-জোর প্রদেশের আল-কাসকিয়ার একটি গণকবরে শাইতাত উপজাতির ওই ২৩০ জনের দেহ পাওয়া গিয়েছে। সিরিয়ার একটি মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থার তরফে আজ জানানো হয়েছে, জঙ্গি আক্রমণে নিহতদের পরিজনেরাই প্রথমে ওই গণকবরের সন্ধান পান। এর আগে একাধিক বার ইরাকের আনবার প্রদেশেও একই কায়দায় নানা উপজাতির মানুষকে মেরে গণকবর দিয়েছিল জঙ্গিরা। কালই জঙ্গিদের বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় ১৫০ জন মহিলাকে হত্যা করে কবর দিয়ে দেয় তারা। তার ২৪ ঘণ্টা পেরোতে না পেরোতেই ফের এই গণকবরের খোঁজ মিলল সিরিয়ায়। একটি মানবাধিকার সংস্থার দাবি, আল-কাসকিয়ায় মৃতদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। জঙ্গিবিরোধী অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে মিলে রুখে দাঁড়ানোয় তাঁদের খুন করা হয়েছে বলে ওই সংস্থার দাবি।