ক্ষমতা দখলের এক বছর পূর্তিতে কাবুলে তালিব বাহিনীর উল্লাস। সোমবার। ছবি: পিটিআই
বিমানের চাকা কাবুলের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটি ছোঁয়ার পরে প্রথম যে দৃশ্যটা দেখা যায়, সেটা হল বাদামি স্কার্ফ আর কালো বোরখা পরা এক মহিলা বসে বিদেশি যাত্রীদের পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মারছেন। তবে বিমানবন্দরের কাউন্টারে কোনও মহিলাকে কাজ করতে দেখে গোটা দেশের নারী স্বাধীনতার যে ছবিটা মনের মধ্যে গেঁথে যায়, তার সঙ্গে বাস্তবের ফারাক অনেকটা। অন্তত আফগানিস্তানের মতো দেশে তো বটেই। কারণ তালিবানি শাসনে আফগান নারীরা ভাল নেই একেবারেই। নিজেদের মুখেই সে কথা গত এক বছরে বহু বার বলে বলে ক্লান্ত তাঁরা।
ঠিক এক বছর আগে, ২০২১-এর ১৫ অগস্টে আশরফ গনি দেশ ছেড়ে পালানোর পরে কাবুলের রাশ হাতে নিয়েছিল তালিবান। দ্বিতীয় বারের জন্য। প্রায় দু’দশক পরে ফের ক্ষমতায় ফেরে তারা। তবে এই ফেরার সঙ্গে তাদের প্রথম দফার দেশ শাসনের তফাত ছিল বহু ক্ষেত্রে। আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে কয়েক বছর ধরে আলোচনা, দোহা চুক্তির পরে আফগানিস্তানের শাসনভার হাতে নিয়েছিল তালিবান। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অজস্র। কিন্তু তার মধ্যে ক’টা তারা পূরণ করতে পেরেছে, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল আগে থেকেই।
গত বছর এই সময়টায় শুধু অরাজকতার ছবি দেখেছিল কাবুল বিমানবন্দর। তালিবানের আতঙ্কে তখন দেশ ছাড়তে মরিয়া ছিলেন স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সাধারণ আফগানরা। আফগানিস্তানের মাটি থেকে আমেরিকান বাহিনী পুরোপুরি প্রত্যাহারের আগে কেউ দেশ ছাড়তে পেরেছিলেন। কেউ পারেননি। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গিয়েছিল বিমানবন্দরের ছবিও।
কিন্তু যাঁরা রয়ে গেলেন, কেমন আছেন তাঁরা? প্রথম সারির এক ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের কাছে তালিবানি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন কাবুলের উচ্চশিক্ষিত মহিলারা। সম্প্রতি সরকারি স্তরে কর্মরত মহিলাদের ডেকে বলা হয়েছে, তাঁরা যেন পরিবারের কোনও পুরুষ সদস্যের হাতে নিজেদের চাকরি তুলে দেন। সে জন্য চাওয়া হয়েছে সিভি-ও। ‘‘এটা আমার চাকরি। গত ১৭ বছর ধরে বহু পরিশ্রম করে এটা আমি টিকিয়ে রেখেছিলাম। কষ্ট করে পড়াশোনা করে স্নাতকোত্তর পাশ করেছিলাম। এখন আবার শূন্যে ফিরে গিয়েছি,’’ বললেন অর্থ মন্ত্রকের প্রাক্তন এক মহিলা কর্মী। নাম প্রকাশ করতে চান না কেউই। কিন্তু সকলের বক্তব্যই প্রায় সমান। কষ্ট করে নিজেদের অর্জন করা চাকরি পরিবারের পুরুষ সদস্যের হাতে ছেড়ে দিতে চান না তাঁরা। রাজস্ব বিভাগের এক প্রাক্তন মহিলা কর্মী জানালেন, মাথা ও গোটা শরীর ঢেকে রাস্তায় বেরোনোর পরে এক বার এক তালিবানি রক্ষী তাঁকে আটকে বহু প্রশ্ন করছিলেন। তাঁকে তিনি সপাটে জবাব দেন যে, হিজাব ছাড়াও বহু জরুরি কাজ রয়েছে যার দিকে এখন সরকারের মন দেওয়া উচিত।
তালিবান সরকার অবশ্য দাবি করেছে, অনেক ক্ষেত্রে এখনও মহিলাদের কাজ করার অনুমতি দেওয়া আছে। যদিও সে সংখ্যাটা হাতে গোনা। বিমানবন্দর, শিক্ষা ক্ষেত্র আর নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া অন্য কোনও কাজেই এখন আর দেখা যায় না আফগান মহিলাদের। যাঁদের সরকারি চাকরি কার্যত কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তাঁরা এখনও মাইনে পান বলে দাবি করা হলেও সেই অঙ্কটা খুবই সামান্য বলে জানিয়েছেন বরখাস্ত হওয়া মহিলা কর্মীরাই।
আফগান নারীদের উচ্চ শিক্ষার দরজাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে আগেই। হেরাটের এক মেধাবী ছাত্রী যেমন জানাল, ক্লাসে প্রথম হওয়া সত্ত্বেও লেখাপড়া বন্ধ করে বসে থাকতে হচ্ছে তাকে। দ্বাদশের পরীক্ষায় পাশ না-করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারবে না সে। কবে তালিবান মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার দরজা ফের খুলবে সেই আশায় বসে আছে সে। তবে নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিতে নারাজ ওই কিশোরী। তার জেদ, এর শেষ দেখে ছাড়বে সে।
এ সবের সঙ্গেই রয়েছে দেশের প্রত্যন্ত এলাকার খরা আর দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ ছবি। রাষ্ট্রপুঞ্জ আগেই জানিয়েছিল, গোটা দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ অনাহারে ধুঁকছেন। ঘোর প্রদেশের অন্তত দু’টি জেলায় ইতিমধ্যেই দুর্ভিক্ষের কথা ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। বৃষ্টির অভাবে ফসল ফলছে না রুক্ষ জমিতে। নুর মহম্মদ নামে এক তরুণ চাষি বললেন, ‘‘দারিদ্র আর দুর্ভিক্ষের সঙ্গেও তো লড়াই চালাতে হয়। আর সেটা বন্দুকের লড়াইয়ের থেকে অনেক বড় লড়াই।’’
আসলে পশ্চিমের সমর্থনে চলা সরকারের আমলে যে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সাহায্য আর ত্রাণ আফগানিস্তান পেত, তা গত এক বছর ধরে বন্ধ। খরার কারণে গম উৎপাদনও ধাক্কা খেয়েছে অনেক জায়গায়। এই পরিস্থিতিতে উন্নত দেশগুলি ত্রাণ না-পাঠালে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হতে চলেছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিভিন্ন সংগঠন। তালিবানের স্বাস্থ্য দফতরের অধিকর্তা, উচ্চশিক্ষিত আব্দুল সাতার মাফাক অবশ্য খোলাখুলিই বললেন, ‘‘গোটা বিশ্বের নজর আফগানিস্তানের উপরে পড়া দরকার। মানুষের প্রাণ বাঁচানোটা জরুরি। আর সেখানে রাজনীতির কোনও স্থান নেই।’’