বেহিসেবি গাড়িতেই শেষ অঙ্ক

মারা গেলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জন ফোর্বস ন্যাশ। ভারতীয় সময় রবিবার সকালে আমেরিকার নিউ জার্সিতে এক ট্যাক্সি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী অ্যালিসিয়া। ন্যাশের বয়স হয়েছিল ৮৬, অ্যালিসিয়ার ৮২। প্রাথমিক রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, দু’জনের কেউই সিটবেল্ট বাঁধেননি। ট্যাক্সি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আর একটি ট্যাক্সির সঙ্গে ধাক্কা মারে পথের পাশের রেলিঙে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় দু’জনের। এই পৃথিবীতে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদের অভাব নেই। তাঁদের মধ্যে নোবেল-বিজেতাও ডজন-ডজন। ওঁদের ভিড়ে ন্যাশ এক ব্যতিক্রমী চরিত্র।

Advertisement

পথিক গুহ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৫ ০৩:০৮
Share:

মারা গেলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জন ফোর্বস ন্যাশ। ভারতীয় সময় রবিবার সকালে আমেরিকার নিউ জার্সিতে এক ট্যাক্সি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী অ্যালিসিয়া। ন্যাশের বয়স হয়েছিল ৮৬, অ্যালিসিয়ার ৮২।

Advertisement

প্রাথমিক রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, দু’জনের কেউই সিটবেল্ট বাঁধেননি। ট্যাক্সি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আর একটি ট্যাক্সির সঙ্গে ধাক্কা মারে পথের পাশের রেলিঙে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় দু’জনের।

এই পৃথিবীতে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদের অভাব নেই। তাঁদের মধ্যে নোবেল-বিজেতাও ডজন-ডজন। ওঁদের ভিড়ে ন্যাশ এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। ১৯৯৪ সালে যখন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ন্যাশকে, সেটা শুধু এক বিরাট আবিষ্কারের স্বীকৃতিই ছিল না। ব্যক্তিগত জীবনে এক গভীর খাদ থেকে উত্তরণের স্বীকৃতিও ছিল।

Advertisement

বিপুল প্রতিভার অধিকারী, উপন্যাসের মতো উত্থান-পতনসমৃদ্ধ জীবনের অধিকারী ন্যাশ সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে আছেন ২০০১ সালে রন হাওয়ার্ড নির্মিত চলচ্চিত্র ‘আ বিউটিফুল মাইন্ড’-এর নায়ক হিসেবে। ওই বায়োপিক তৈরি হয়েছিল নিউ ইয়র্ক টাইমসের অর্থনীতির সংবাদদাতা সিলভিয়া নাশার-রচিত ওই নামের বইটি থেকেই। ‘আ বিউটিফুল মাইন্ড’ পেয়েছিল চারটি অস্কার, শ্রেষ্ঠ ফিল্মের পুরস্কার সমেত। বায়োপিকে ন্যাশের চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছিলেন, ‘গ্ল্যাডিয়েটর’-খ্যাত সেই রাসেল ক্রো দুর্ঘটনার খবর পেয়ে টুইট করেছেন, ‘‘মর্মাহত...আমার সমবেদনা ন্যাশ পরিবারের প্রতি। আশ্চর্য দাম্পত্য! চমৎকার মন, চমৎকার হৃদয়!’’

জন্ম ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার ব্লুফিল্ড শহরে। বাবা ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার, মা ল্যাটিন ভাষার শিক্ষিকা। ছোটবেলা থেকেই ন্যাশ দারুণ মেধাবী। ফলে ডাকনাম জুটে গিয়েছিল একটা— ‘বড় মাথা’। বাবাকে দেখে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার শখ, তাই সে সময়কার বিখ্যাত শিক্ষায়তন কার্নেগি টেক-এ ভর্তি। প্রযুক্তিবিদ্যার পাঠক্রম ভাল লাগল না। তাই কোর্স বদলে কেমিস্ট্রি। তা-ও ভাল নয়। শেষমেশ গণিত। কারণ ততদিনে পড়া হয়ে গিয়েছে এরিক টেম্পল বেল-রচিত ‘মেন অব ম্যাথমেটিক্স’। প্রাতঃস্মরণীয় গণিতজ্ঞদের সংক্ষিপ্ত জীবনীর সংকলন। পণ্ডিত তো নয়, ওঁরা যেন এক এক জন ভগবান, ন্যাশের তা-ই মনে হল।

গণিতের পীঠস্থান তখন প্রিন্সটনে ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্স স্টাডিস। যেখানে তখন আলো করে বসে আছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, জন ফন নয়ম্যান, রবার্ট ওপেনহাইমার, কুর্ট গোয়েডেল-রা। ন্যাশ পিএইচডি করতে ওখানে। দরখাস্তে অধ্যাপকের মন্তব্য, ‘‘দিস ম্যান ইজ আ জিনিয়াস।’’

সত্যিই তাই। ক্লাসে দেখা যায় না ন্যাশকে। তিনি বরং সহপাঠীদের সঙ্গে আড্ডায় ব্যস্ত, আর দেখা হলে অধ্যাপকদের চোখা-চোখা প্রশ্নে বিব্রত করতে তৎপর। কমনরুমে বন্ধুদের সঙ্গে নিজের আবিষ্কৃত এক বোর্ডগেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গেমের নাম ? বন্ধুরা বলে, ‘ন্যাশ’। ওই গেম পরে অন্য নামে বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ ডলার কামিয়েছে এক বহুজাতিক কোম্পানি।

বয়স মাত্র ২১। পিএইচডি থিসিস মাত্র ২৭ পৃষ্ঠার। ওই থিসিসের জন্যই পরে নোবেল প্রাইজ।

বিষয়? তা বলতে গেলে চলে আসবে সময়ের কথা। সে বড় সুখের সময় নয়। দু-দু’টো পরমাণু বোমা ধ্বংস করেছে জাপানের দুই শহর। সে মারণাস্ত্র আবার বানিয়ে ফেলেছেন আমেরিকার শত্রু, সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন। আমেরিকা করবে কী? হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, নাকি স্তালিনকে টেক্কা দিতে বানাবে আরও ভয়ঙ্কর হাইড্রোজেন বোমা? প্রশ্ন নীতির, কিন্তু পর্যালোচনায় কাজে এল বেশ কিছু কাল আগের গণিতের এক তত্ত্ব। পোশাকি নাম ‘গেম থিওরি’। নাক পছন্দ নাকি নরুন, নির্ধারণের যুক্তিনির্ভর পন্থা। তত্ত্বটার কথা বিশদে বলা হয়েছিল এক বইতে। ফন নয়ম্যান এবং অস্কার মরগ্যানস্টার্ন-রচিত ‘থিওরি অব গেমস অ্যান্ড ইকনমিক বিহেভিয়ার’। এই বই সাহায্য করে সিদ্ধান্ত নিতে, হাইড্রোজেন বোমা বানাতে হবে। আমেরিকা বানিয়ে ফেলে তা। ন্যাশ পরে এই তত্ত্বকেই আরও এগিয়ে নিয়ে যান।

বাজার! অর্থনীতি! এ সব আসলে কী-দিলে-কী-পাব আর আমি-যখন-এটা-পাচ্ছি-তখন-আমার-প্রতিবেশী-কী-পাচ্ছে— এ সবেরই হিসেবনিকেশ। কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর কিছুটা সহযোগিতার সমাহার। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানদের ক্রেতা কাড়ার লড়াই আর ক্রেতাদের মধ্যে বেশি সস্তায় জিনিস কেনার প্রবণতা। এ সবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্তটি কী, সে়টা কি বলতে পারে গণিত? এক সময় পণ্ডিতেরা ভাবতেন সিদ্ধান্ত শুধুই মনস্তত্ত্বের ব্যাপার। ফন নয়ম্যান এবং মরগ্যানস্টার্ন দেখিয়ে দিয়েছিলেন, জটিলতার ওই জঙ্গলে পথ দেখাতে পারে গণিতও। ন্যাশ তাঁর আবিষ্কারে যা বললেন, তার মূল কথা এ রকম— রাম এবং শ্যামের দু’জনের সেরা লাভ এক জনের পছন্দের সুবাদে নয়, দু’জনের যৌথ পছন্দে। সেরা লাভ হাসিল করতে হলে দু’জনের পছন্দ জোট বাঁধতে হবে। না হলেই গোলমাল। এক জনের লাভ আর এক জনের ক্ষতি নয়, বহুজনের একসঙ্গে লাভ-ক্ষতির হিসেবকিতেব হল ‘ন্যাশ সাম্য’। যার গুরুত্ব প্রসঙ্গে এক গণিতজ্ঞ বলেন, ‘‘জীববিদ্যায় ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কার যেমন যুগান্তকারী, অর্থনীতিতে ন্যাশ সাম্যও তাই।’’ দর্শন, জীববিদ্যাতেও তার প্রয়োগ।

কিন্তু তার পর? ন্যাশের জীবনে অন্ধকার। একের পর এক প্রেমিকা বদল। সমকামী সম্পর্কও একাধিক। এক বার গ্রেফতার হলেন পুরুষদের শৌচাগার থেকে। ক্রমে মানসিক জীবন বিপর্যস্ত। ন্যাশ তখন উদ্ভ্রান্ত, মানসিক বিকারগ্রস্ত। চাকরি খুইয়ে বেকার। প্রায় বদ্ধ পাগল হিসেবে ঘুরে বেড়ান প্যারিস কিংবা লন্ডন। কখনও ভাবেন তিনি আন্টার্কটিকার প্রেসিডেন্ট, কখনও ‘শোনেন’ তাঁকে পাঠানো এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়ালদের গোপন বার্তা। হায়, একদা যিনি যুক্তির শ্রেষ্ঠ পূজারী, তিনিই কি না আবোল তাবোলের সম্রাট! ফল মারাত্মক। বারবার মানসিক হাসপাতালে ভর্তি। সেই ঘোর দুঃসময়ে সর্বক্ষণ তাঁর পাশে পাশে স্ত্রী অ্যালিসিয়া।

মানসিক বিকৃতির কারণে অনেক পুরস্কার থেকে গিয়েছিল অধরা। এমনকী গণিতের সেরা শিরোপা ফিল্ডস মেডেলও। ১৯৯০-এর দশকে নোবেল কমিটি ভাবতে বসে, অর্থনীতিতে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা আবিষ্কার কি বঞ্চিত হবে পুরস্কার থেকে? ন্যাশের মানসিক অবস্থা কেমন, তিনি কি পারবেন সুস্থ অবস্থায় সুইডেনে এসে পুরস্কার নিতে? ন্যাশের বন্ধু এবং ছাত্র, যাঁরা তত দিনে দিকপাল পণ্ডিত, তাঁরা নোবেল কমিটিকে খবর দেন, বহুকালের চিকিৎসার পর ন্যাশ আরোগ্যের দিকে। আর, ন্যাশ সাম্য নোবেল প্রাই়জ না পেলে তা হবে পৃথিবীতে বিখ্যাততম পুরস্কারটির ইতিহাসে এক কলঙ্ক। অবশেষে নোবেল কমিটির সিদ্ধান্ত। ন্যাশ সশরীরে সুইডেনে এসে নিলেন পুরস্কার।

মনে পড়ছে এক ঘটনা। ২০০৪ সাল। ইতালির ত্রিয়েস্ত শহরে নোবেলজয়ী আবদুস সালাম প্রতিষ্ঠিত গবেষণাগারের ৪০ বছর পূর্তি উৎসব। আমন্ত্রিত বহু পণ্ডিত বিজ্ঞানী। সস্ত্রীক ন্যাশও হাজির সেই উৎসবে। আমরা সাংবাদিকেরা অনেকেই খুব চেষ্টা করেছিলাম ন্যাশ-এর এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউয়ের জন্য। হল না। অ্যালিসিয়া কারও সঙ্গে স্বামীকে কথা বলতে তো দিলেনই না, প্রায় পুলিশি প্রহরায় আগলে রাখলেন সর্বক্ষণ। এই পরিচর্যা শুধু সহধর্মিণীর নয়, যোগ্য সহকারীরও।

মনে পড়ছে আরও এক ছবি। টেলিভিশনের পর্দায় অস্কার পুরস্কার অনুষ্ঠান লস অ্যাঞ্জেলেসে। আ বিউটিফুল মাইন্ডের মনোনয়ন অনেক বিভাগে। শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অন্যতম দাবিদার রাসেল ক্রো হাজির। আমন্ত্রিত জন এবং অ্যালিসিয়াও। বসেছেন ক্রো-র পাশেই। নাহ, গ্ল্যাডিয়েটর-এর অভিনেতার ভাগ্যে জুটল না সেরার শিরোপা। তবে সেরা ছবি অবশ্যই আ বিউটিফুল মাইন্ড! ক্যামেরা এ বার তাক করল প্রথম সারিতে বসা রাসেলের দিকে। চমৎকার দৃশ্য— সহাস্য ক্রো নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালেন! বোধহয় বলতে চাইলেন, এক অমূল্য জীবনকে চিত্রায়িত করার জন্য আমি ভাগ্যবান!

সেই জীবনের নায়ক চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। অকৃত্রিম বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়েই। অকস্মাৎ। জীবনের মতো তাঁর মরণও হয়ে থাকল নাটকীয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement