Bangkok Earthquake

সারা জীবন তাড়া করে বেড়াবে ওই আর্তনাদ-আকুতি

আমাদের অফিস একটি ২৭ তলার বহুতলে। ব্যাঙ্ককের সব বহুতলের মতেই এই বাড়িটিও ঝড় বা অতি প্রবল হাওয়ার মোকাবিলা করার মতো করেই তৈরি করা হয়েছে। সেই বাড়িও দুলতে শুরু করেছে।

Advertisement

অয়ন চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৫ ০৮:২৩
Share:

উদ্ধারকাজ চলছে ব্যাঙ্ককে ভেঙে পড়া বহুতলে। শনিবার। ছবি: রয়টার্স।

৪০০ মানুষ।

Advertisement

একটা সরু সিঁড়ি।

অন্ধকার।

Advertisement

২০ তলা থেকে নামতে নামতে মনে হচ্ছিল, আর কোনও দিন বাইরের পৃথিবীটা দেখতে পারব না। দেখা হবে না প্রিয়জনের সঙ্গে। চতুর্দিকে তখন শুধু আর্তনাদ আর ঠেলাঠেলি।

কালকের দিনটা শুরু হয়েছিল আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতোই। ১টা ২৫। অফিসে বসে কাজ করছি, চারদিকে কি-বোর্ডের খুটখাট, সহকর্মীদের চাপা স্বরে কথাবার্তা। মাঝেমধ্যে কড়া কফির গন্ধও ভেসে আসছে কারও ডেস্ক থেকে। লাঞ্চ করে ফিরে, নিজের ডেস্কে বসে, তত ক্ষণে আমিও ফের কাজে ডুবে গিয়েছি।

হঠাৎ দেখি, ছাদ থেকে ঝুলন্ত আলোগুলো যেন দুলছে। আমার মাথাটাও যেন ঘুরে গেল। প্রেশার বেড়েছে নাকি? ভাবতে ভাবতেই শুনি এক সহকর্মীর আর্ত চিৎকার— ‘ভূমিকম্প, ভূমিকম্প’! মুহূর্তে শোরগোল পড়ে গেল। চেয়ার উল্টে, টেবিল ঠেলে সবাই তখন ছুটেছে ইমার্জেন্সি দরজার দিকে।

আমাদের অফিস একটি ২৭ তলার বহুতলে। ব্যাঙ্ককের সব বহুতলের মতেই এই বাড়িটিও ঝড় বা অতি প্রবল হাওয়ার মোকাবিলা করার মতো করেই তৈরি করা হয়েছে। সেই বাড়িও দুলতে শুরু করেছে। আমার নিজের দফতর এই বাড়ির বিশ তলায়। শুরু হল সেখান থেকে পড়িমড়ি করে নামা। লিফ্‌ট দেখলাম চলছে না। তা ছাড়া, এ ধরনের আপতকালীন পরিস্থিতিতে লিফ‌্‌ট ব্যবহার করা উচিতও নয়।

যে-ই সিঁড়ির মুখে পৌঁছেছি, আবার বাড়িটা দুলে উঠল। আর তখনই আলোগুলো কয়েক বার কেঁপে সব নিভে গেল। নিকষ অন্ধকার চারদিকে। আর্তনাদে তখন কান পাতা দায়। হুড়োহুড়ি করে সবাই তখন নীচে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এ ওর ঘাড়ে পড়ে যাচ্ছে। কোনও ক্রমে উঠে আবার ছুটছে। তখন মাথায় একটাই কথা ঘুরছিল—প্রকৃতির রোষ থেকে বাঁচতে গিয়ে এই সরু সিঁড়িতে পদপিষ্ট হয়ে যেন না মরি।

কত সেকেন্ড বা কত মিনিট লেগেছিল ২০ তলা থেকে নামতে, তা ঘড়িতে দেখার সময় পাইনি। কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তকেই তখন অনন্ত মনে হচ্ছিল। মাথা কাজ করছে না, শুধু যন্ত্রের মতো শরীরটা সিঁড়ি ভেঙে চলেছে। বিকট একটা ভয় পুরো মনকে গ্রাস করে নিয়েছে। শুধু একটা ইন্দ্রিয় যেন কাজ করছে— শ্রবণেন্দ্রিয়। চিৎকার, ঈশ্বরের কাছে চাপা স্বরে আকুতি, ভয়ে গোঙানি— কী না ছিল সেই সম্মিলিত ধ্বনিতে। যে শব্দ চোখ বন্ধ করে এখনও শুনতে পাচ্ছি। যে শব্দ আমাকে অনেক দিন তাড়া
করে বেড়াবে।

তাড়া করবে বেড়াবে সেই দৃশ্যটাও, যা কালকেই সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। কোনও ক্রমে আমাদের অফিস থেকে বেরিয়ে বাইরে তাকাতেই বুকটা হিম হয়ে গেল। ভয়ে। আতঙ্কে। বিস্ময়ে। আমাদের অফিসের অনতিদূরেই একটি বহুতল তৈরি হচ্ছিল। দেখলাম তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে সেটি। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ত্রিশ তলা বাড়িটার জায়গায় ভাঙা কংক্রিটের একটা স্তূপ তৈরি হয়ে গেল। ওখানে তো শুনেছিলাম ৩০০-রও বেশি নির্মাণকর্মী কাজ করছিলেন। সবাই কি ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়লেন? পরে শুনলাম, বেশির ভাগ শ্রমিককে উদ্ধার করা গেলেও ৭৫ জন এখনও নিখোঁজ। ধ্বংসস্তূপ থেকে আপাতত ১১টি মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে।

একটা কথা না বললেই নয়। এত বড় মাপের একটি ভূমিকম্পের পরের পরিস্থিতি যে ভাবে এখানকার প্রশাসন সামাল দিচ্ছে, তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। কালকেই দেখলাম লার্ডসিন হাসপাতালের সব রোগীকে বার করে এনে হাসপাতালের সামনের রাস্তায় রেখে চিকিৎসা চালানো হচ্ছে। ইমার্জেন্সির রোগীদের মুখে অক্সিজেন মাস্ক। বিশাল বিশাল পাখা লাগানো রয়েছে। ছোটাছুটি করছেন চিকিৎসক ও নার্সেরা।

হতবাক অবস্থা কাটতে না কাটতেই মোবাইলে আত্মীয়-বন্ধুদের উৎকণ্ঠা ভরা মেসেজ আসতে শুরু করল। অসংখ্য মিস্‌ড কল। কোভিডের সময়ে মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে এসেছিলাম। তার পরে কালকের এই প্রাকৃতিক তাণ্ডব! খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে, বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নিজের ভাগ্যকে, আর এক বার, অশেষ ধন্যবাদ দিলাম।

লেখক ব্যবসায়িক বিশ্লেষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement