প্রতীকী ছবি
এ যেন সেই ‘চালুনি বলে, সূচ, তোর পিছনে কেন ফুটো?’
গত প্রায় সাত দশক ধরে মহাকাশে বিস্তর আবর্জনা জমা করার পর আমেরিকা এখন খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে ভারতের এ-স্যাট পরীক্ষায়। বলছে, ‘ছিঃ ছিঃ এত্তা জঞ্জাল!’
অথচ গত সাত দশক ধরে তো বিভিন্ন উপগ্রহ পাঠানো আর ভিন গ্রহে প্রাণ খোঁজার নামে তো কম মহাকাশযান পাঠায়নি আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জাপান! তার ফলে বিস্তর জঞ্জাল বা আবর্জনা জমা হয়েছে মহাকাশে। জমা রয়েছে। থাকবে আরও বহু দিন।
আমেরিকা আবর্জনা ছড়িয়েছে ভারতের ৫০ গুণেরও বেশি!
আমজনতার কাছে পৌঁছনোর লক্ষ্যে পেন্টাগনে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের যে ওয়েবসাইটটি রয়েছে, সেই ‘স্পেস-ট্র্যাক.ওআরজি’র দেওয়া পরিসংখ্যান বলছে, গত ২৭ মার্চ, ভারতের অ্যান্টি-স্যাটেলাইট মিসাইল বা এ-স্যাট ছোড়ার আগে পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে আমেরিকা আবর্জনা ছড়িয়েছে ভারতের তুলনায় ৫০ গুণেরও বেশি! ওই সময় পর্যন্ত কক্ষপথে ভারতের ছড়ানো আবর্জনার টুকরোর (স্পেস ডেব্রি) সংখ্যা যেখানে মাত্র ৮০টি, সেখানে আমেরিকার ছড়ানো আবর্জনার সংখ্যা ৪ হাজার ৯১টি। তার পরেই রয়েছে রাশিয়া। যাদের ছড়ানো ৪ হাজার ২৫টি আবর্জনার টুকরো এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে ঘুরে চলেছে। ভারতের তুলনায় রাশিয়ার ‘অবদান’ও ৫০ গুণ! আমেরিকা ও রাশিয়ার সঙ্গে এ ব্যাপারে টক্কর দিতে দেরি করেনি চিন। কক্ষপথে চিনের ছড়ানো আবর্জনার সংখ্যা ৩ হাজার ৫২৪টি। যা ভারতের প্রায় ৪৫ গুণ!
নাসার প্রধান জিম ব্রিডেনস্টিন পেন্টাগনের ওই পরিসংখ্যান জানেন না, তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তবু তার পরেও ব্রিডেনস্টাইন মঙ্গলবার নাসার কর্মীদের এক সমাবেশে বলেছেন, ‘‘ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে পৃথিবীর প্রায় ৩০০ কিলোমিটার উপরের কক্ষপথে থাকা নিজেদের ‘মাইক্রোস্যাট’ উপগ্রহ ধ্বংস করে মহাকাশে ছোট ও বড় চেহারার ৪০০টি আবর্জনা ছড়িয়েছে ভারত। যা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। আরও ৭০ কিলোমিটার উপরের কক্ষপথে থাকা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের পক্ষে ওই আবর্জনার টুকরোগুলি হয়ে উঠেছে অত্যন্ত বিপজ্জনক। বিপদাপন্ন করে তুলেছে মহাকাশচারীদেরও। অন্তত ৪৪ শতাংশ বিপদ বাড়িয়েছে মহাকাশ স্টেশনের।’’
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ ব্যাপারে এখন বিস্তর আলাপ-আলোচনা চলছে। আলোচনা চলছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’ ও প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থায় (ডিআরডিও)।
দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, ‘‘এই চাপানউতরে যেটুকু তথ্য আমজনতার কাছে পৌঁছেছে, তা হল; মহাকাশ পরিক্রমায় পারদর্শী কোনও দেশই পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে আবর্জনা ছড়ানোর দায় এড়াতে পারে না। গত ২৭ মার্চের ঘটনার পর দোষটা যদি ভারতের হয়ে থাকে, তা হলে এ ব্যাপারে পথ দেখানোর দায়িত্বটা আমেরিকা, চিন বা রাশিয়া কেউই এড়িয়ে যেতে পারে না। ভারতের তুলনায় মহাকাশের কাঁধের বোঝাটা যে আমেরিকা, রাশিয়া, চিনই বেশি বাড়িয়েছে গত কয়েক দশক ধরে, সেই সত্যটাও তারা অস্বীকার করতে পারে না।’’
মহাকাশে আবর্জনা: দেখুন ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ভিডিয়ো
‘স্পেস’ বা মহাকাশ বলতে কী বোঝানো হয়?
স্পেস বা মহাকাশ বলতে কী বোঝানো হয়, সেটা জানাটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বোঝা উচিত কোনটা আকাশ আর কোনটা মহাকাশ। আন্তর্জাতিক উড়ানগুলি মাটি থেকে ৩৫/৪০ হাজার ফুট উপর দিয়ে ওড়ে। সেটা আকাশ। কোনও উড়ানই মহাকাশে ওড়ে না। কিন্তু উৎক্ষেপণের পর কোনও রকেট আর আকাশে থাকে না। অত্যন্ত দ্রুত গতিবেগে তা মহাকাশে পৌঁছে যায়। উপগ্রহকে পৌঁছে দেয় পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে। যা মহাকাশই।
আরও পড়ুন- ভারতের এ-স্যাট পরীক্ষা ‘ভয়ঙ্কর’ বলল নাসা! শঙ্কা, টুকরো লাগতে পারে মহাকাশ স্টেশনে
আরও পড়ুন- চিনের পাঠ্যবইতে এই ভারতীয় চিকিৎসক, সে দেশে রয়েছে তাঁর মূর্তিও, কেন জানেন?
আমাদের বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। ট্রপোস্ফিয়ার, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার, আপার স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার, আয়নোস্ফিয়ার আর ওজনোস্ফিয়ার। আবার একেবারেই বায়ুমণ্ডল নয়, এমনও একটি স্তর রয়েছে পৃথিবীর চার পাশে। সেটা তার চৌম্বক ক্ষেত্র। যাকে বলে, ম্যাগনেটোস্ফিয়ার।
একটি স্তর থেকে আরও উপরের স্তরে গেলে ক্রমশই পাতলা থেকে আরও পাতলা হয়ে যেতে শুরু করে বায়ুমণ্ডল। আয়নোস্ফিয়ারে সব কিছুই থাকে আয়ন বা আধানযুক্ত কণার অবস্থায়। ফলে, সেখানে আমাদের পরিচিত বায়ুমণ্ডলটাই থাকে না। তার উপরে থাকে সূর্য থেকে ছুটে আসা অত্যন্ত বিষাক্ত কণা আর নানা ধরনের মহাজাগতিক বিকিরণ ও কণার হানাদারি রোখার জন্য ওজোন গ্যাসের একটি পুরু চাদর। যাকে বলা হয়, ওজোনোস্ফিয়ার।
মোহনপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (আইসার-কলকাতা) সেন্টার অফ এক্সেলেন্স ইন স্পেস সায়েন্সেস ইন্ডিয়া (সেসি)-র অধিকর্তা বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী দিব্যেন্দু নন্দী বলছেন, ‘‘মোটামুটি ভাবে আমরা স্পেস বা মহাকাশ বলতে বোঝাই ওই আয়োনোস্ফিয়ার বা আপার আয়োনোস্ফিয়ারটাকেই। যা শুরু হয় পৃথিবীর পিঠের (সারফেস) উপরে ৬০ কিলোমিটার বা ৩৭ মাইল থেকে ১ হাজার কিলোমিটার বা ৬২০ মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে।’’
পেন্টাগনের মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের যে ওয়েবসাইট ‘স্পেস-ট্র্যাক.ওআরজি’র দেওয়া পরিসংখ্যান বলছে, এ ছাড়াও প্রচুর আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মহাকাশে। চিনের ছড়ানো এমন আবর্জনার সংখ্যা ১ হাজার ৩৫৩টি। রাশিয়ার ১৫ হাজার ২০৭টি। আমেরিকার ৬ হাজার ৩২৫টি। ব্রিটেনের মাত্র ১৫টি হলেও, ভারত, জাপান ও ফ্রান্সের যথাক্রমে ৩৪৩, ৩০০ এবং ৭৩৩টি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আবর্জনাগুলি অতটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে না মহাকাশে। সেগুলি মহাকাশচারী বা মহাকাশযানের পক্ষে ততটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে না।
তবে ভারতের ‘এ-স্যাট’ পরীক্ষার পর নাসার এই উদ্বেগকে ‘স্বাভাবিক’ বলেই মনে করেন বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আইআইএ)-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক সুজন সেনগুপ্ত। তাঁর কথায়, ‘‘খুব স্বাভাবিক ভাবেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নাসা। কারণ, পৃথিবীর কাছেপিঠে থাকা বস্তগুলির (নিয়ার-আর্থ অবজেক্ট বা ‘নিও’) উপর বিশ্বে নজর রাখে একমাত্র নাসাই। গ্রহাণু বা মহাকাশের আবর্জনা থেকে মহাকাশযান বা উপগ্রহের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে কি না, তার উপর নিয়মিত নজর রাখে নাসাই। তাই ‘এ-স্যাট’ পরীক্ষার পর মহাকাশ স্টেশনের নিরাপত্তা নিয়ে নাসার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। চিন যখন ২০০৭ সালে এমন পরীক্ষা চালিয়েছিল, তখন তার কড়া সমালোচনা করেছিল ভারত।’’
সব আবর্জনাই বিপজ্জনক হয় না কেন?
দিব্যেন্দু জানাচ্ছেন, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একটা নিজস্ব টান রয়েছে। যাকে বলা হয়, ‘অ্যাটমস্ফেরিক গ্র্যাব’। সেই টানেই কক্ষপথে থাকা আবর্জনার টুকরোটাকরাগুলি একটি সময়ের পর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের দিকে ছুটে আসতে শুরু করে। যেন পৃথিবীর বুকেই তা আছড়ে পড়বে। কিন্তু তা হয় না। কারণ, তাদের পথে পড়ে বায়ুমণ্ডলের আয়নোস্ফিয়ার। সেখানে থাকা আয়ন বা আধানযুক্ত কণাদের সঙ্গে তাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। খুব দ্রুত গতিতে তারা ছুটে আসছে বলে সেই সংঘর্ষে সেই গতিশক্তি তাপশক্তিতে রুপান্তরিত হয়। ফলে, তারা জ্বলে-পুড়ে যায়, ভূপৃষ্ঠে পৌঁছনোর অনেক আগেই।
উদ্বেগের কারণ হয় কোন আবর্জনাগুলি?
যেগুলি ১০ সেন্টিমিটার বা চার ইঞ্চির চেয়ে বড় আকারের, তারাই উদ্বেগটা বাড়ায় বেশি। নাসা পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা এমন ২৩ হাজার আবর্জনার সন্ধান পেয়েছে এখনও পর্যন্ত। যাদের মধ্যে চেহারার দিক দিয়ে ১০ হাজার টুকরো অত্যন্ত বিপজ্জনক। ভয়ঙ্কর। ওই টুকরোগুলির এক-তৃতীয়াংশই মহাকাশে জমা হয়েছে চিনের অ্যান্টি-স্যাটেলাইট মিসাইল পরীক্ষার দৌলতে, ২০০৭-এ।
কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্সের (আইসিএসপি) অধিকর্তা, বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘চিনা পরীক্ষায় যে আবর্জনাগুলি জমা হয়েছে মহাকাশে, সেগুলি রয়েছে পৃথিবীর ৮৫০ কিলোমিটারেরও বেশি উপরের কক্ষপথে। যেখানে বায়ুমণ্ডল প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে, সেগুলি দীর্ঘ দিন ধরে ঘুরবে কক্ষপথে। সেগুলির পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের দিকে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এইগুলিই মহাকাশযান বা মহাকাশচারীদের পক্ষে বেশি বিপজ্জনক। তবে ভারতের এ-স্যাট পরীক্ষার পর যে ৪০০টি টুকরো জমা হয়েছে মহাকাশে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের কক্ষপথ প্রদক্ষিণের পথে পড়ে যেতে পারে। তাতে প্রতি ৪৫ মিনিট অন্তর মহাকাশ স্টেশনের সঙ্গে সেগুলির সংঘর্ষের আশঙ্কা থেকেই যায়।’’
ভারতের গর্বের উপগ্রহ ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর সায়েন্স অপারেশনের প্রধান, পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার অফ অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা)-র জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘মহাকাশে ফেলা সব আবর্জনাই থাকে পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে। সেগুলির আকার আর কক্ষপথে প্রদক্ষিণের সময় সেগুলি কোনও মহাকাশযান বা উপগ্রহের পথে পড়ে গেলে তা খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তেমন পরিস্থিতি তৈরি হলে তা মহাকাশ স্টেসনের পক্ষেও হয়ে উঠতে পারে বিপজ্জনক।’’
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (‘এসা’)