এর পর অনেক কসরত করে পশ্চিম ইউক্রেনের নিরাপদ অঞ্চলে এসে পৌঁছেছি আমরা। বর্তমানে স্টুডেন্ট ডরমেটারির একটা ঘরে রয়েছি আমি, ওলগা আর আমাদের প্রিয় পোষ্য।
ছবি রয়টার্স।
এক সময়ের কিভ শহরের বাসিন্দা আমিই এখন শরণার্থী শিবিরের ভল্যান্টিয়ার। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বদলে দিয়েছে আমাদের অনেকের পরিচয়। ঠিকানাও।
ইউক্রেনের কিভ শহরটা স্বপ্নের মতো সুন্দর। নিজের দেশ ছেড়ে এখানে এসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম অনেকটাই ব্যক্তিগত এবং পেশাগত কারণে। তাই বলে এমন নয় যে, এই দেশকে আপন করে নিইনি। পরিপাটি করে সাজানো এই শহরের মধ্যে যেন আলাদা প্রাণ খুঁজে পেতাম।
সেই প্রাণের কিভ শহর ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হল শেষ পর্যন্ত। ২ মার্চ রাতে বাড়িঘর, নিজের অস্তিত্ব সব পিছনে ফেলে পরিবার নিয়ে পালিয়ে এলাম পশ্চিম ইউক্রেনের দিকে। রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লাম যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে এক সময়ে গিয়ে আশ্রয় নিলাম ভূগর্ভস্থ মেট্রো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। সেখানেই পরের কয়েকটা রাত কাটিয়েছি।
যখন সমস্ত পৃথিবী ইউক্রেনের আবেদনের সামনে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, তখন শহরের মেট্রো স্টেশনের অন্ধকার সুড়ঙ্গগুলোই তাঁদের বুকে টেনে নিয়েছে। দু’বেলা খাওয়ার জোটার নিশ্চয়তা নেই, প্রবল শীতে উষ্ণ বিছানা নেই। রয়েছে সারি সারি উৎকণ্ঠা-ভরা মানুষের মুখ। এক রাতের মধ্যে রাতারাতি আমরা কিভের বাসিন্দা থেকে বদলে গিয়েছি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শরণার্থীতে!
এর পর অনেক কসরত করে পশ্চিম ইউক্রেনের নিরাপদ অঞ্চলে এসে পৌঁছেছি আমরা। বর্তমানে স্টুডেন্ট ডরমেটারির একটা ঘরে রয়েছি আমি, ওলগা আর আমাদের প্রিয় পোষ্য। ওলগা চেমরিস (Olga Chemirys) আমার স্ত্রীয়ের নাম। সে স্থানীয় মেয়ে। ওলগা ইউক্রেনের নাগরিক হওয়ার আমরা দু’জন শরণার্থী শিবিরে বিনামূল্যে খাবার পাচ্ছি। কিন্তু চেষ্টা করছি, সে খাবার না নিতে। যত ক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কাছে টাকা আছে, কিনে খেতে। আমরা
চাই না, যাঁদের সত্যিই বিনামূল্যের খাবার প্রয়োজন এই সময়ে, তাঁদের ভাগেরটা আমাদের কারণে ফুরিয়ে যাক।
তা ছাড়া, এই এলাকার স্থানীয়েরা খুবই সাহায্য করছেন। প্রয়োজনের সব কিছু তাঁরাই ব্যবস্থা করছেন। কিভ ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু দেশ ছেড়ে যাব না এখনই। আমি আর ওলগা ঠিক করেছি, যত ক্ষণ অবধি এখানে পরিস্থিতি ঠিক রয়েছে, এখানেই থাকব। ভারতে আমার পরিবার রয়েছে, তাঁরা সকলেই চিন্তিত আমাদের নিয়ে। ফোনে কথাও হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ইউক্রেন ছেড়ে ভারতে ফেরার কথা ভাবতে পারছি না।
যুদ্ধ শুরুর আগে পর্যন্ত কিভ শহরে স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান এবং অভিনেতা হিসাবে কাজ করতাম। মানুষকে সাময়িক আনন্দ দেওয়া ছিল আমার পেশা। এখনও সেটাই চেষ্টা করছি। পশ্চিম ইউক্রেনে এখন যুদ্ধের ভয়ে পালিয়ে আসা বহু মানুষের ভিড়। এঁরা সকলেই ইউক্রেন ছেড়ে ইউরোপের অন্য দেশে যাওয়ার জন্য ভিড় করেছেন সীমান্তে। কিন্তু অনেকেরই অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই। কারও আবার অন্য দেশে আত্মীয়-পরিজন নেই যে, সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেবেন। এঁদের সকলের ঠাঁই হয়েছে শরণার্থী শিবিরে।
আমি আপাতত এঁদের হয়ে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছি। দেশ থেকে বেরোতে সাহায্য করছি সাধ্যমতো। এখানে অনেক ভারতীয় পড়ুয়াও রয়েছেন, যাঁরা যে কোনও ভাবে পোল্যান্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি সীমান্তে পৌঁছোতে চাইছেন। তাঁদেরও যতটা সম্ভব সাহায্যের চেষ্টা করছি। থাকার ব্যবস্থা, খাওয়া, উপযুক্ত রুট দিয়ে সীমান্তে পৌঁছনোর ব্যবস্থা— আমাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু করা সম্ভব।
এখনও পর্যন্ত আমাদের দু’জনের হাতে টাকা আছে। পরে কী হবে, জানি না। তবে আমার ভারতের পরিবার আর ইউরোপের বন্ধুবান্ধবেরা জানিয়েছে, এ নিয়ে যেন কোনও দুশ্চিন্তা না করি। এই বিপর্যয়ে সকলেই সাহায্য করতে প্রস্তুত।
আমার মতো অনেকেই এখানে এই কাজ করছেন। দেশ ছেড়ে না গিয়ে স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন। শুধু নিজের প্রাণের কথা নয়, অন্য মানুষের প্রাণ বাঁচানোর কথাও ভাবছেন।
যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আগে কখনও আমার হয়নি। আমার জন্ম ভারতে, সেখানেই বড় হওয়া। জন্ম শংসাপত্রে লেখা নাম সৌরভ মিশ্র। ফলে, সেই অর্থে যুদ্ধ কী জিনিস, তা কখনও দেখতে হয়নি আমায়। অথচ, ৩৮ বছর বয়সে যে ভাবে বোমাবর্ষণে চোখের সামনে একের পর এক বাড়ি-ঘর ধুলোয় মিশে যেতে দেখলাম, যে ভাবে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় বদলে গেল শহরের মানচিত্র, তা মানসিক ভাবেও ভীষণ ক্ষতি করেছে।
আমার ইউক্রেনীয় শাশুড়ি আমাদের কিভের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে হাঁটাপথে দশ মিনিট দূরে থাকেন। তিনি এখনও পর্যন্ত সেখানে আটকে রয়েছেন। জানি না, কী ভাবে কবে তাঁকে বার করে আনতে পারব।
লেখক: স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান
অনুলিখন: চৈতালি বিশ্বাস