আর কয়েকটি দিন। ইতিহাসের পাতায় উঠে যাবে ২০১৬। টাইম ম্যাগাজিনের কভারের পাতা ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ করেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। নির্বাচনী সমীক্ষাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জিতে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছেন বিশ্বকে। আড় ভেঙে বিস্মিত রাষ্ট্রনেতারা একে একে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলছেন। ট্রাম্পের ক্যাবিনেটের একে একে নাম ঘোষণা হচ্ছে। ওবামা পরবর্তী বিশ্বের প্রহর গোনা শুরু হয়েছে। আটলান্টিকের অন্য দিকে, ক্রেমলিনের প্রাসাদে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখে হয়তো তৃপ্তির হাসি। এ বছরটা তার ঝুলি ভরে দিয়েছে। আলেপ্পো থেকে হোয়াইট হাউস— যেখানে হাত দিয়েছেন সোনা ফলেছে। অবশ্য তা সহজ পথে হয়নি। রক্ত ঝরেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরাপরাধের। তাতে পুতিনের হাসি মলিন হবে না। চাঁদের বুকে তো কলঙ্ক থাকে!
১৯৯১-এর ২৫ ডিসেম্বর। শেষ বারের জন্য কাস্তে-হাতুড়ি-তারার পতাকা উড়ল ক্রেমলিনে। ভেঙে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তার পরে নিয়ত নিজের পরিচয় খুঁজে চলেছে রাশিয়া। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেৎসিন দিতে পারেননি। কিন্তু প্রাক্তন কেজিবি অফিসার ভ্লাদিমির পুতিন অবশেষে সেই পরিচয় দিতে পরেছেন রাশিয়াকে। যে পরিচয় আসলে ঠাণ্ডা যুদ্বের সময়ের পৃথিবীকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে। গত তিন দশকের বিশ্বায়িত পৃথিবীকে রাশিয়ার সুবিধার মতো বদলে নিচ্ছেন পুতিন। একে একে তার লক্ষ্য পূরণও হয়ে চলেছে। খুব সংক্ষেপে, তিনটি লক্ষ্য পুতিনের। এক- চিরশত্রু আমেরিকাকে দুর্বল করা। দুই- সামরিক শক্তি হিসেবে ন্যাটোকে এবং অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে (ইইউ) দুর্বল করা। তিন- বিশ্ব জুড়ে হারিয়ে যাওয়া রাশিয়ান দাদাগিরিকে নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠা করা। সময় বলছে এ বছরে তিনটি কাজেই সফল পুতিন।
এর মধ্যে সব কিছুই যে পুতিনের পরিকল্পনা মাফিক হয়েছে তা নয়। ওবামা-পুতিনের দ্বৈরতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত এগিয়ে থাকলেন পুতিন। শুরু হয়েছিল ইউক্রেন দিয়ে। ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অঙ্গীভূত করায় অনেক দিন পরে ন্যাটো ও রাশিয়ার পরস্পরের দিকে অশনি শানায়। যুদ্ধ না শুরু হলেও ইইউ-কে সঙ্গে নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। মনে হয়েছিল প্রবল অর্থনৈতিক চাপে পিছু হঠবে রাশিয়া। কিন্তু পুতিন পাল্টা চালে মাত করলেন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধকে কাজে লাগালেন। গণবিদ্রোহে প্রায় ক্ষমতা হারাতে বসা প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের পক্ষে সামরিক শক্তি নিয়ে হাজির হল রাশিয়া। বর্ষশেষে দেখা যাচ্ছে, আসাদ-বিরোধী, আমেরিকা-সহ পশ্চিম বিশ্বের সমর্থন পাওয়া বিদ্রোহীরা আলেপ্পোয় আত্মসমর্পণ করছেন। সুদৃঢ় হয়েছে আসাদের অবস্থান। যাকে হঠানোর ডাক দিয়েছিলেন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। মধ্য এশিয়ায় পুতিনের প্রভাবের বলয় উজ্জ্বল হয়েছে। রাশিয়ার সমর্থন ছাড়া আগামী দিনে মধ্য এশিয়ার সমস্যাগুলির সমাধান আপাতত অসম্ভব।
সামরিক শক্তির ব্যবহার করে কোনও লক্ষ্যে পৌঁছনো পুতিনের প্রিয় নীতি। আজ যা আলেপ্পোয় করা হয়েছে, ১৯৯৯-এ চেচনিয়ার বিদ্রোহ দমনে তাই করা হয়েছিল। বোমাবর্ষণে চেচনিয়ার রাজধানী গ্রজনি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। চলেছিল অবিরাম গণহত্যা। অনেকটা যেন আলোপ্পোর ড্রেস রিহার্সাল। চেচনিয়া আইনত রাশিয়ার অংশ হওয়ায় বাকি বিশ্বকে চুপ থাকতে হয়েছিল। আর আজ যে হত্যালীলার পথে আলেপ্পোর অধিকার ফিরে পাচ্ছেন বাসার আল-আসাদ, তাতেও কিছু আপত্তি উঠলেও কণ্ঠস্বরে জোর নেই। আর যে ইইউকে সঙ্গে নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, তার থেকে বেরিয়ে যেতে হবে ব্রিটেনকে। ব্রেক্সিট পুতিনের কাছে মেঘ না চাইতে জল। ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে আলাদা ভাবে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী রাশিয়া। কিন্তু ইইউ থাকতে তা সম্ভব নয়। ইইউ যত দুর্বল হবে ততই পুতিনের সুবিধা। ব্রেক্সিটের মধ্যে দিয়ে প্রাথমিক ভাবে কাজটা অন্তত শুরু হয়ে গিয়েছে।
যদি বলেন ভাগ্য বলে কিছু আছে, তবে শুধু এক বার নয়, এ বছরে বার বার তা পুতিনের সঙ্গ দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদয়ে পুতিনের হাত নেই। কিন্তু ট্রাম্পের বিশ্ব ভাবনা একেবারে পুতিনের ছাঁচে বসানো। ট্রাম্প বিশ্বায়নের প্রতি সন্দিগ্ধ। ভুবনায়নের চাপে আমেরিকার যেখানে যন্ত্রণা সেখানে উপশমের মলম লাগাতে চান ট্রাম্প। ফলে ইইউ তাঁর চক্ষুশূল। ন্যাটো তার তীব্র অপচ্ছন্দের। এগুলির বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদ্গার করেছেন ট্রাম্প। আর পুরনো শক্রর মধ্যেই সন্ধি খুঁজে পেয়েছেন। পুতিনের প্রশংসার পঞ্চমুখ থেকেছেন। সুযোগ লুফে নিয়েছেন পুতিনও। ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসাতে রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থা মদত দিয়েছে ঘুরপথে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এই অভিযোগের স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে সংশয় থাকলেও এটা পরিষ্কার রাশিয়া এত দিনে তাদের প্রিয় মার্কিন প্রেসিডেন্টকে পেয়ে গিয়েছে। আর এ সংশয় আরও নিমূর্ল হয়েছে গত মঙ্গলবার। ট্রাম্প তাঁর বিদেশ সচিব পদে বেছে নিয়েছেন বিশ্বের নামজাদা তেল সংস্থা ‘এক্সনমবিল’-এর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) রেক্স টিলারসনকে। ২০১৩ সালে যাঁকে বিদেশি নাগরিকদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান ‘অর্ডার অফ ফ্রেন্ডশিপ’ দিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। রাশিয়ার উপরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধী টিলারসন। রাশিয়ার তেল সংস্থা ‘রসনেফ’-এর সঙ্গে ‘এক্সনমবিল’-এর ব্যবসা এতে বাধা পাচ্ছে। এ নিষেধাজ্ঞা উঠলে ভরে উঠবে এ দু’সংস্থার ঝুলি। পুতিন এক বছরে আর কী চাইতে পারেন।
তবে শুধু ট্রাম্প নয়, বেশ কিছু দেশের নামজাদা নেতারা পুতিন ভক্ত। ইউরোপ জুড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির যে উত্থান হচ্ছে সেখানে পুতিনকে প্রায় হিরো ওয়ারশিপ করা হয়। যেমন ব্রেক্সিটের পক্ষে আগুন ঝরানো নেতা ব্রিটিশ নেতা নাইজেল ফারাজ। প্রকাশ্যে পুতিনের প্রশংসা করেছেন। সামনেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রান্সিস ফিলোন আর মারিন লে পেন। প্রবল দক্ষিণপন্থী পেন সরাসরি পুতিনের প্রশংসাতেই ক্ষান্ত থাকেননি, অভিযোগ, রাশিয়ার সাহায্যপুষ্ট ব্যাঙ্ক থেকে প্রায় ৮০ লক্ষ ডলার ঋণ নিয়েছেন। মধ্যপন্থী ফিলোন আবার ক্রিমিয়া দখলের জন্য রাশিয়ার উপরে বসানে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পক্ষে। মলডোভা, বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড— শাসকেরা পুতিনের দিকে ঝুঁকে। পুতিনের মতোই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিয়ে তাঁদেরও হাজারো অভিযোগ রয়েছে। নিজের দেশেও পুতিনের জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। এত দিন পরে স্তালিনের মতো শক্তহাতে বিশ্বে দাপিয়ে বেড়ানোর মতো নেতা পেয়েছে রাশিয়ার নাগরিকবৃন্দ। অতএব বর্ষশেষে পুতিনের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি থাকাটা দোষের নয় আদৌ। সে হাসি চওড়া করে দিল ফোর্বসের তালিকা। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বলা হয়েছে পুতিনকে। এই নিয়ে পরপর চার বার। এ বার দু’নম্বরে ট্রাম্প।
আরও পড়ুন: বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্ব হলেন রুশ প্রেসিডেন্ট