মুহাম্মদ ইউনূস। —ফাইল চিত্র।
বুধবার দিল্লি থেকে আমেরিকার গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গাবার্ডের ধমক বাংলাদেশকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। তার উপরে নতুন একটি বিতর্ক ইউনূসের অনুগামী ছাত্রনেতা হাসনাত আবদুল্লা, সার্জিস আলমদের সেনা বাহিনীর একেবারে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হাসনাত, সার্জিসদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামী থেকে নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরের মতো মৌলবাদী ও জঙ্গি সংগঠনগুলি। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ় জ়ামানের পদত্যাগ দাবি করে কট্টরপন্থীদের একটি মিছিল ক্যান্টনমেন্টেও ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছিল। তার পর থেকে রাজধানী জুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করেছে সেনা। সব মিলিয়ে শুক্রবার ঢাকার পরিস্থিতি থমথমে। উত্তেজনা সর্বত্র। সঙ্গে পল্লবিত হচ্ছে অজস্র গুজব। রাজনীতির এলোমেলো বাতাসে কেউ কেউ সম্ভাব্য সেনাশাসনের গন্ধ পাচ্ছেন।
শুক্রবার দিনভর ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের মিছিলে রাজধানী ঢাকা উত্তাল হয়ে উঠেছিল। আওয়ামী লীগ ও সহযোগীদের নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি সংগঠনের পাশাপাশি নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরও মিছিল করেছে। আবার ‘ইউনূস সরকার উচ্ছেদ করে দেশে সেনাশাসন কায়েম’ করার দাবিতেও এক দল মানুষ মিছিল বার করেছেন ঢাকায়। এর মধ্যে সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের কর্মীরা ধানমন্ডিতে একটি ঝটিকা মিছিল বার করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ৫ অগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানোর পরে এটিই ছিল শেখ হাসিনার দলের সব চেয়ে বড় মিছিল। এই মিছিল শেষ হওয়ার পরে যুব মহিলা লীগের এক নেত্রী এবং ছাত্র লীগের তিন কর্মীকে আটক করে বেদম মারধর করে বিএনপি কর্মীরা। পুলিশ এই চার জনকে গ্রেফতার করেছে।
নাটকের শুরু বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ছাত্র সংগঠন থেকে তৈরি নতুন দল এনসিপি-র নেতা হাসনাত আবদুল্লার একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়ে। হাসনাতের দাবি, ১০ দিন আগে দুই সঙ্গী-সহ তাঁকে সেনা বাহিনীর দফতরে ডেকে বলা হয়— সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে। ইতিমধ্যেই অনেক দল সেটা মেনে নিয়েছে। তাঁরা যেন আপত্তি না করেন। হাসনাতের দাবি— তাঁরা শোনামাত্র আপত্তি করলে বলা হয় শিরিন শরমিন চৌধুরী, শেখ ফজলে নুর তাপস এবং সাবের হোসেন চৌধুরীর মতো ‘পরিষ্কার’ ভাবমূর্তির নেতানেত্রীরা তাঁদের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন। তাঁরা শেখ হাসিনাকে উপেক্ষা করে ‘বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ’ করবেন। আসন সমঝোতার ভিত্তিতে এই নতুন আওয়ামী লীগকে
মেনে নিতে হবে। হাসনাতের অভিযোগ, তাঁরা রাজি না-হওয়ায় ধমকানো হয়। উপস্থিত সেনা কর্তা তাঁদের বলেন, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে ‘ইনক্লুসিভ’ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার পরিণাম তাঁদের ভোগ করতে হবে।
হাসনাতের অভিযোগ, এই ‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ-এর পরিকল্পনা আসলে ভারতের, সেনারা তা বাস্তবায়ন করছে। বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এক প্রতিনিধিকে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস জানান, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনও পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। তার জবাবে হাসনাত ফেসবুকে লেখেন— ‘ড. ইউনূস, আওয়ামী লীগ ৫ অগস্টই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। উত্তরপাড়া (ক্যান্টনমেন্ট) ও ভারতের প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগের চ্যাপ্টার ওপেন করে লাভ নেই।’
এর পরেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পর পর মিছিল বার করা হয়। পল্টন মোড়ে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকররমে জুম্মার নমাজের পরে গাজ়ায় ইজ়রায়েলি হামলার বিরুদ্ধে মিছিলের ডাক দিয়েছিল কয়েকটি সংগঠন। সেই মিছিলের পাশপাশি উত্তরার মসজিদের সামনে মিছিলে স্লোগান শোনা যায়— ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, ‘ওয়াকার না হাসনাত, হাসনাত-হাসনাত’, ‘ক্যান্টনমেন্ট না রাজপথ, রাজপথ-রাজপথ’। আবার এক দল লোক নিজেদের আমজনতা দাবি করে মিছিল করে স্লোগান দেন, ‘অবিলম্বে ইউনূস সরকার উচ্ছেদ করো’, ‘বাংলাদেশে সেনাশাসন চাই’,
‘ইউনূস হটাও সেনাপ্রধান আনো, অবিলম্বে নির্বাচন করো’। সংবাদ মাধ্যমকে তাঁরা বলেছেন, “১/১১-র সেনাশাসনে রাজনীতির লোক বিপদে পড়লেও আমজনতা ছিল স্বস্তিতে। এই সরকারের আমলে রাজনীতিকেরা ঘুষের টাকায় পাঁচতারা হোটেলে ইফতার খাচ্ছে, আমজনতার দুর্গতির শেষ নেই। আমরা তাইসেনাশাসনই চাইছি।”
এর মধ্যেই বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভি বলেন, “গণহত্যায় অভিযুক্ত নেতাদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিলে আমরা আপত্তি করব কেন? বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী।” কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ফেসবুকে পোস্ট দেন— আওয়ামী লীগকে ফেরানোর চেষ্টা মানুষ মানবেন না। অবিলম্বে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করা হোক। একই কথা বলেন, হেফাজতে ইসলামীর নেতারাও। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের আবার বলেন, “আওয়ামী লীগের নেতারা দোষী হতে পারেন, দলটির কী দোষ? ড্রাইভার খারাপ হলে কি গাড়ির দোষ?” রাতে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে এনসিপি-র প্রধান নাহিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীসব সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে হবে। তাদের নেতাদের গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করতে হবে। তার আগে নির্বাচন নয়।
এর মধ্যেই সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক ছাত্র নেতা আসিফ মাহমুদ একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নানা বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন। আসিফ জানিয়েছেন, আন্দোলনের গোড়া থেকেই আমেরিকার দূতাবাসের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ রেখে চলেছেন। ৫ অগস্ট হাসিনার পতন না হলে তাঁরা ‘সশস্ত্র অভ্যুত্থান’ শুরু করতেন। এ জন্য ‘যা যা দরকার’ সব ঠিক করা ছিল। আসিফের দাবি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে তাঁরা ইউনূসের নাম বললে সব চেয়ে বেশি আপত্তি করেছিলেন সেনাপ্রধান ওয়াকার। তিনি বলেছিলেন, ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। ‘পরিষ্কার’ কারও নাম প্রস্তাব দিতে। ছাত্ররা ইউনূসের নামে অনড় থাকায় জেনারেল নাকি বলেছিলেন, ‘বুকে পাথর চাপা দিয়ে আমি ইউনূসের নাম মেনে নিলাম!’