সে দিনের আতঙ্ক তাড়া করে আজও

কাবুলে চিকেন স্ট্রিটে সহকর্মী মারাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যখন গাড়িতে উঠছি, সূর্য ডুবে অন্ধকার নেমে এসেছে। দু’পাশে দুই স্থানীয় দেহরক্ষী, হাতে তাদের স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। আফগান রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে আমার তখনকার কর্মস্থল সামান্যই দূরে।

Advertisement

দেশকল্যাণ চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৬ ০৯:২৪
Share:

কাবুলে চিকেন স্ট্রিটে সহকর্মী মারাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যখন গাড়িতে উঠছি, সূর্য ডুবে অন্ধকার নেমে এসেছে। দু’পাশে দুই স্থানীয় দেহরক্ষী, হাতে তাদের স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। আফগান রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে আমার তখনকার কর্মস্থল সামান্যই দূরে। কিন্তু গাড়িতে সকলেরই মুখ গম্ভীর। দেহরক্ষীরা আগেই ঠারেঠোরে জানিয়ে দিয়েছে— আমরা রয়েছি বটে, কিন্তু তেনারা হামলা চালালে এই দু’জনের ফৌজ কিছুতেই রুখতে পারবে না।

Advertisement

সে দিন কিছু হয়নি বটে, কিন্তু আফগানিস্তানে যাঁরা যে কাজেই যান না কেন, দুরু দুরু বক্ষ তাঁদের নিত্যসঙ্গী। আমার ধারণা, আগা খান ফাউন্ডেশনের হয়ে মহিলা ও শিশুদের উন্নয়নে কাজ করতে যাওয়া জুডিথ ডিসুজাও এর বাইরে ছিলেন না।

চিকেন স্ট্রিটকে কাবুলের নিউ মার্কেট এলাকা বলা যায়। কিন্তু আফগান সহকর্মী শ মারাই তার বোনের বিয়ে উপলক্ষে তাঁর বাড়িতে যখন নিমন্ত্রণ করেন, শ্বেতাঙ্গ সহকর্মীদের যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পরের দিন দেখা করে নিমন্ত্রণ রক্ষা করে আসার সময়ে একটাই কথা মাথায় এসেছিল— এক দিন না এক দিন তো মরবই। ঘুরে আসা যাক বন্ধুর বাড়ি। শুনেছি জুডিথও গিয়েছিলেন তাঁর কোনও বন্ধুর বাড়ি। সেখান থেকে ফেরার সময়েই অপহৃত হয়েছেন তিনি।

Advertisement

কিন্তু আজ থেকে বছর আটেক আগেও পরিস্থিতি কিছুটা অন্য রকম ছিল। ভারতীয়দের চেয়ে ঝুঁকিটা বেশি ছিল মার্কিন ও ইউরোপীয়দের। তখন ভারতীয়দের বন্ধু বলেই মনে করতেন স্থানীয় আফগানরা। এখন কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে ভারতীয়রাও তালিবানের টার্গেট। জানি না, কূটনীতিকরা এর কী ব্যখ্যা দেবেন। তবে ও-দেশের জঙ্গিরা দূর থেকে গুলি করে মারার থেকে অপহরণ করাটাকেই পছন্দ করে। এর একটা উদ্দেশ্য, যদি বিদেশি দূতাবাসের সঙ্গে দর কষাকষি করে ডলার আদায় হয়। অন্যটি অবশ্যই আতঙ্ক ছড়ানো। বাকি বিদেশিরা যাতে প্রাণ হাতে করে দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবে।

কাবুলের প্রতি গলিতে যদি দু’‌টো করে ভিডিও-সিডির দোকান থাকে, তবে তিনটি দোকান সিকিউরিটি এজেন্সির। সেগুলির মালিক এক এক জন বন্দুকধারী পালোয়ান, ফোলানো পেশির বাহার ধরে রাখতে যারা নিয়মিত জিমে যায়। তাদের কারও হাতে থাকে একে ৪৭, কারও বা লাইট মেশিনগানের মতো অস্ত্র। সকলেই জানেন জঙ্গিরা হানা দিলে এই রক্ষীরা খড়কুটো, কিন্তু তবু তাদের চাহিদা খুবই। বন্দুকও বিকোয় দোকানে দোকানে। লাইসেন্সের কোনও বালাই নেই।

একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার চিত্রসাংবাদিক হিসেবে ভিন্ন-ভিন্ন সময়ে দু’বার আফগানিস্তানে গিয়ে থাকতে হয়েছে। মাসের পর মাস সেখানে থাকতে হয়েছে। পরেও এক বার কাবুল গিয়েছি। এনজিও থেকে নির্মাণ সংস্থা বা পরিবহণ সংস্থা— সর্বত্র অজস্র ভারতীয়। হোটেলে ভারতীয় কর্মীর ছড়াছড়ি। পঞ্জাব থেকে যে কত ছেলে সেখানে গিয়ে কাজ করছে! মালিকদের বিশ্বাস দেশীয়রা বিদেশি অতিথিদের দেখভালে তেমন পারদর্শী নন। আবার বিদেশিরাও স্থানীয়দের খানিকটা বাঁকা চোখে দেখেন— এরাই জঙ্গিদের এজেন্ট নয় তো! কিন্তু কাবুল, কন্দহর বা হেলমন্দ, সর্বত্রই দেখেছি— যে-সব ভারতীয় সেখানে কাজ করেন, কী আতঙ্ক নিয়ে তাঁরা থাকেন। তাঁরা জানেন, বিপদে পড়লে পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই।

সে বার তার বাড়ি ঘুরে আসার ক’দিন পরে কন্দহর রওনা হওয়ার সময়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল মারাই। বলেছিল, ‘‘আশা করব গোটা অবস্থাতেই কাবুল ফিরবে তুমি। আবার আমার বাড়িতে আসবে। সে দিন যেন এমন কাবুল না-থাকে!’’

ধ্বংসের কাবুল কোনও দিন কি শান্তিতে ফিরতে পারবে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement