—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
বাতাসে যেন একটু বেশিই শীতের চোরাটান। ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে রাত— ঠিক এই সময়ে প্রতি বাঙালির মনে একটি সুরই বাজতে থাকে। সেটি দুর্গাপুজোর সুর। নতুন শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে, খিচুড়ি ভোগ, মিষ্টি খেয়ে, ধূপ ও ধুনুচি সহযোগে উদ্যাপিত হবে বাঙালির প্রিয়তম উৎসব। লন্ডনেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। আর এ বছর দুর্গাপুজো সপ্তাহান্তে পড়ায় সেই আনন্দের মাত্রা আর একটু বেশি।
লন্ডনের সারা শহর জুড়ে কমপক্ষে ৪০টি পুজো হয়। সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড, সুইস কটেজ, ইলিং এবং হ্যারোর পুজো। দক্ষিণ লন্ডনের টুটিং-এও হয় একটি বড় পুজো। এ ছাড়া পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেনের টয়েনবি হল, ইলফোর্ডও সেজে ওঠে দুর্গাপুজো উদ্যাপনে। তবে স্রেফ লন্ডনেই পুজো হয় তা ভাবলে ভুল ভাবা হবে। লন্ডনের বাইরে লিভারপুল, কার্ডিফ ও গ্লাসগোর বাঙালি-যাপনেও পুজোর প্রস্তুতি এখন তুঙ্গে।
এই প্রসঙ্গেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করে ষাট বছর আগে, ১৯৬৩ সালে। দেশ থেকে আসা তরুণ কয়েক জন বাঙালি যুবক প্রায়শই একসঙ্গে সান্ধ্য আড্ডায় যোগ দিতেন। তাঁদেরই উৎসাহে ৩০ জন অ্যাডাম স্ট্রিটের ইন্ডিয়া লিগ অফিসের বেঙ্গলি ইনস্টিটিউটে শুরু হয় সরস্বতী পুজো। আর তার পরেই এক আড্ডায় তাঁদের এক জন হঠাৎ প্রস্তাব দেন দুর্গাপুজো করার। বাকিরা সঙ্গে সঙ্গেই রাজি। সদস্যদের কাছ থেকে দশ পাউন্ড করে চাঁদা তোলা হয়। বাকি টাকা দেন তৎকালীন প্রবাসী ভারতীয়েরা।
যোগাযোগ করা হয় কলকাতার সঙ্গে। অমৃতবাজার পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক তুষারকান্তি ঘোষ তাঁদের দুর্গাপ্রতিমাটি উপহার দেন। প্রথমে কলকাতা থেকে জাহাজে করে স্কটল্যান্ডের অ্যাবার্ডিন বন্দরে আসে প্রতিমা। তার পরে, সড়কপথে লন্ডনে নিয়ে আসা হয় সেটিকে। সান্ধ্য আড্ডা দলের এক সদস্য ছাপাখানায় চাকরি করতেন। তিনি পুজোর ঘোষণা সংক্রান্ত লিফলেট ছাপিয়ে দেন। অক্সফোর্ড স্ট্রিট ও পিকাডেলি সার্কাসে সেগুলো বিলি করা হয়। ‘অম্বালা’ নামের এক ভারতীয় মিষ্টির দোকান দায়িত্ব নেয় নৈবেদ্য তৈরির। অবশেষে বিলিতি শরতের ফুরফুরে রোদ্দুর মেখে রাসেল স্কোয়ারের মেরি ওয়ার্ড সেন্টারে সূচনা হয় লন্ডনের প্রথম দুর্গাপুজোর। আনন্দে মেতে ওঠেন প্রবাসীরা, পুজো দেখার জন্য নামে মানুষের ঢল।
১৯৬৫ সালে পুজো সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ইয়ং মেনস ক্রিশ্চান অ্যাসোসিয়েশনের ভারতীয় শাখায়। ১৯৬৬ সালে আবার পুজো হয় হ্যাম্পস্টেড টাউন হলে। মানুষের ভিড় সামলাতে অবশেষে পুজো সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যামডেন টাউন হলে, যেখানে একেবারে দু’হাজার মানুষ প্রতিমা দর্শন করতে পারেন।
লন্ডন দুর্গোৎসব কমিটি আয়োজিত ক্যামডেনের পুজোটি বর্তমানে সুইস কটেজ লাইব্রেরিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ বছর সেটির ৬০ বছরের হীরকজয়ন্তী। থাকবেন পুজোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক শিল্পপতি লক্ষ্মী এন মিত্তল। আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ নৃত্যানুষ্ঠানের। বিশেষ আকর্ষণ যাত্রা, অভিনীত হবে নবাব সিরাজদৌল্লা পালা। হ্যাম্পস্টেড টাউন হলে অবশ্য পুজো হবে লন্ডন দুর্গাপুজো ও দশেরা অ্যাসোসিয়েশনের।
উত্তর লন্ডনের হ্যারো আর্টস সেন্টারে পুজোর আয়োজন করেছে পঞ্চমুখী বলে তরুণ বাঙালিদের একটি সংগঠন। তাদের পুজো এ বার ১৮ বছরে পা দিল। তার উদ্যাপনে রয়েছে রকমারি পরিকল্পনা। ষষ্ঠীর উদ্যাপন হবে মহিষাসুরমর্দিনীতে। এ ছাড়া অভিনীত হবে হারপুন নামের একটি হাসির নাটক। অষ্টমীর দিন কুচোকাঁচারা সুকুমার রায়ের ‘গোঁফচুরি’ মঞ্চস্থ করবে।
এ বছর ইলিং টাউন হল থেকে গ্রিনফোর্ড হলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে লন্ডন শরৎ উৎসবের পুজো। এ বছর সেটির ১৫ বছরের পূর্তি। তবে, কোনও প্রতিমাই বিসর্জন দেওয়া হয় না। যত্ন করে তুলে রাখা হয় পরের বছরের জন্য।
ঢাকে কাঠি পড়তে আর বেশি দিন নেই। কয়েক দিন পরেই প্যান্ডেল আলো করে বসবেন মা দুর্গা। আলো ও রোশনাইয়ের হই হই উৎসব। প্রবাসের মাটিতে এক টুকরো দেশ খুঁজে পাবেন প্রবাসী মানুষগুলো... শরতের সোনাঝরা রোদ্দুরে।