প্রতীকী ছবি।
আমাদের ছোটবেলায় জন্মদিনের বিশেষ উপহার ছিল বই। তখন স্কুলে পড়ি। মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সাধারণ জ্ঞানের বইতে প্রথম পড়েছিলাম রাষ্ট্রপুঞ্জের কথা। কিন্তু তখন তো ভাবিনি যে, রাষ্ট্রপুঞ্জের হয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করার সৌভাগ্য ঘটবে এক দিন!
গত একুশ বছর ধরে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম বা ডব্লিউএফপি)-র কর্মী হিসেবে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রত্যক্ষ করেছি প্রাকৃতিক বা সামাজিক বিপর্যয় এবং ক্ষুধা কী ভাবে একে অপরকে ত্বরান্বিত করে। ক্ষুধার বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই এবং শান্তি স্থাপনের এই নিরলস প্রচেষ্টারই স্বীকৃতি স্বরূপ ২০২০-র নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হল ডব্লিউএফপি।
এ বছরটা অন্য বছরের থেকে আলাদা। কোভিড-১৯ অতিমারি সারা পৃথিবী জুড়ে প্রাণঘাতী রূপ ধারণ করেছে। ভাইরাসের সংক্রমণে মারা গিয়েছেন ১৭ লক্ষ মানুষ। আর রুটি-রুজি হারিয়ে মৃত্যুর মুখে পৌঁছে গিয়েছেন আরও কয়েক কোটি। এই শোচনীয় পরিস্থিতিতে খাদ্য সঙ্কটের মোকাবিলা এক বিশেষ মাত্রা পেয়েছে।
অতিমারির আগেই আমাদের সংস্থা ৮৮টি দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষকে পুষ্টিকর খাদ্যের জোগান দিত। প্রতিদিন গড়ে ৫৬০০টি ট্রাক, ১০০টি বিমান এবং ৩০টি জাহাজ ব্যবহার করে ক্ষুধার্ত মানুষদের কাছে খাবার পৌঁছে দিত ডব্লিউএফপি। অতিমারি পরিস্থিতিতে সেই বিশাল কর্মকাণ্ড বিশেষ মাত্রা পেল। বিভিন্ন দেশে লকডাউন ও আন্তর্জাতিক উড়ান পরিষেবা যখন প্রায় বন্ধ, আকাশে তখন শুধু ডব্লিউএফপি-রই বিমান। এই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও ডব্লিউএফপি-র সরবরাহ-ক্ষমতার ওপর বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। অতিমারির প্রথম কয়েক মাসে আমাদের সংস্থার বিশেষ উড়ান পরিষেবার মাধ্যমে দেড় হাজার উড়ান বিভিন্ন সংস্থার ২৫,৭৮২ জন স্বেচ্ছাসেবীকে ৬৮টি গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে। তা ছাড়া, ডব্লিউএফপি-র কার্গো পরিষেবা ১৭১টি দেশে চিকিৎসা-সামগ্রীও পৌঁছে দিতে পেরেছে।
কোভিড-১৯ এর প্রকোপের আগে বিশ্বে ১৫ কোটি মানুষ ছিলেন তীব্রভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীন, এখন সেই পরিসংখ্যান গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭ কোটিতে। ২০২০-র প্রথম দশ মাসে ডব্লিউএফপি প্রায় ১২,৬০০ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা ৬৭টি দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছে। অতিমারির তাণ্ডব শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক কোটি সত্তর লক্ষ শিশুকে প্রতিদিন পুষ্টিকর মিড ডে মিল পৌঁছে দিতাম আমরা। ২০২০-র শেষে এসে আমাদের দায়বদ্ধতা বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। নিরাপদে স্কুল ফের চালু করার জন্য আমরা বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছি, যাতে অন্তত সাত কোটি শিশু আবার পড়াশোনা শুরু করতে পারে এবং একই সঙ্গে স্কুলে পুষ্টিকর খাবার পেতে পারে।
এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে ডব্লিউএফপি। অবশ্যই এ এক বিশাল সম্মান। তবে একটা কথা বলতে পারি।
কাজের সূত্রে যখনই পৃথিবীর কোনও প্রত্যন্ত প্রান্তে আমাদের পৌঁছে দেওয়া খাবার কোনও দুঃস্থ পরিবারের জীবন রক্ষা করেছে বা কোনও শিশুর মুখের হাসি ফুটিয়েছে, তখন যা আনন্দ পেয়েছি, ব্যাক্তিগত ভাবে তা নোবেল জয়ের থেকে কম আনন্দের নয়!
লেখক বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)-র সিনিয়র উপদেষ্টা