চড়া সুর ডোনাল্ড ট্রাম্পের। সোমবার নিউহ্যাম্পশায়ারের ম্যাঞ্চেস্টার শহরে। ছবি: রয়টার্স
সমকামী বিদ্বেষ, ধর্মীয় মৌলবাদ ও তাতে আবার আইএস যোগ! তিনটির কোনও একটিকে আলাদা করে অরল্যান্ডোয় সমকামী গণহত্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারছেন না কেউ। উঠে আসছে নতুন নতুন তথ্য। কিন্তু এই ত্র্যহস্পর্শেই বুঝি পৌষমাস ডোনাল্ড ট্রাম্পের!
সমকামী বিদ্বেষ ও তার জেরে হত্যা আগেও দেখেছে আমেরিকা। বিশেষ করে ফ্লোরিডা। কিন্তু শনিবার শেষ রাতে ওমর মতিন নামে এক যুবক যে কাণ্ড ঘটিয়েছে, হতাহতের সংখ্যায় তা গোটা দেশের রেকর্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা এক বন্দুকবাজের হামলা আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ছবিটাই দিয়েছে বদলে। নিন্দুকদের উড়িয়ে সম্ভাব্য রিপাবলিকান প্রার্থ়ী ট্রাম্প ফের জোর গলায় বলতে পারছেন, ‘‘অরল্যান্ডো হত্যা সূচনা মাত্র। এমনটা যে হবে, আমি আগেই বলেছিলাম। অবস্থা দিনে দিনে আরও খারাপ হবে। মুসলিমদের আমেরিকায় আসতেই দেওয়া উচিত নয়।’’ এরই সঙ্গে তিনি চাঁছাছোলা ভাষায় তুলোধোনা করতে পারছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে।
গত বছর হোয়াইট হাউসের যে ব্র্যাডি রুম থেকে ওবামা দেশের বন্দুক সংস্কৃতির অবসান চেয়ে বলেছিলেন, ‘উই কান্ট ওয়েট (আমরা আর বসে থাকতে পারি না)’— গত কাল সেই ঘরে গিয়ে ফের তাঁকে বলতে হয়েছে ‘ঘৃণা’ ও ‘হিংসা’র রমরমা বন্ধের কথা। এফবিআইয়ের কাছ থেকে সর্বশেষ খোঁজখবর নেওয়ার পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আজ বলেছেন, ‘‘সন্ত্রাসবাদী হামলা হিসেবেই দেখা হচ্ছে একে। তবে এর পিছনে আইএস বা বিদেশি কোনও প্ররোচনা রয়েছে, এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি।’’
কিন্তু বিদায়ের বছরে ওবামার এই বক্তব্যের চেয়েও ঢের বেশি প্রচার পাচ্ছে ট্রাম্পের মুখে ওবামার সমালোচনা। আজ এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, ‘‘ওবামা হয় এ ব্যাপারটা বোঝেন না, কিংবা সকলের চেয়ে বেশি বোঝেন। দু’টি অবস্থানের কোনওটাই মেনে নেওয়া যায় না।’’ পরে কিছুটা সুর নরম করে তিনি বলেন, ‘‘অনেকে মনে করেন ওবামা ব্যাপারটা বুঝতে চান না।’’ প্রচারের শুরু থেকেই মুসলিমদের আমেরিকায় আসার বিরুদ্ধে বলে বিতর্কে জড়িয়েছেন এই ধনকুবের। টুইটারে এখন একের পর এক গোলা ছুড়ছেন তিনি। ট্রাম্পের কথায়, ‘‘প্রেসিডেন্ট ওবামা অরল্যান্ডো হত্যা প্রসঙ্গে মৌলবাদী ইসলাম কথাটাই বলতে পারলেন না। এটা না পারলে তিনি পদত্যাগ করুন।’’
লক্ষ্য করার বিষয়, প্রেসিডেন্ট ওবামার দায় নেই ট্রাম্পের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার। যেটা রয়েছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনের। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মৌলবাদী ইসলাম শব্দটা বলতে আমার কোনও বাধা নেই। তা বলে ইসলাম ধর্মের সকলকে ‘দানবীয়’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করাটাও বিপজ্জনক। সেটা আসলে আইএস-কেই সাহায্য করা।’’ একই সঙ্গে হিলারি মনে করিয়ে দিয়েছেন, যুক্তির বদলে হুজুগে ইন্ধন দিয়ে সমস্যা মেটে না।
ট্রাম্প অবশ্য এতে দমছেন না। আজও লস অ্যাঞ্জেলেসে সমকামীদের শোভাযাত্রায় যাওয়ার পথে আর এক সশস্ত্র ব্যক্তিকে আটক করেছে পুলিশ। সে কথাও আজ তুলে আনেন ট্রাম্প। তবে অরল্যান্ডোর ঘটনার সঙ্গে লস অ্যাঞ্জেলেসের কোনও যোগ বা মিল আছে কিনা, তা এখনও জানায়নি প্রশাসন। অরল্যান্ডো-কাণ্ডের জেরে ট্রাম্প ও হিলারি দু’জনেই এ দিনের নির্বাচনী সভা বাতিল করেন।
ভোট-রাজনীতির চাপানউতোরে নেতা-নেত্রীরা যে ব্যাখ্যাই দিন, মার্কিন গোয়েন্দারা কিন্তু এখনও নিশ্চিত নন, ঠিক কী রয়েছে অরল্যান্ডো হত্যাকাণ্ডের মূলে? তাঁদের সন্দেহ ঘাতক ওমর মতিন তার বাবা সিদ্দিক মির মতিনের কাছ থেকেই মৌলবাদী মুসলিম ভাবধারা ও সমকামী-বিদ্বেষের পাঠ নিয়ে থাকতে পারে। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, এ দেশের আফগান সম্প্রদায়ের মধ্যে খোঁজখবর করে তাঁরা জানতে পেরেছেন, এক সময়ে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরফ ঘানির সমর্থক ছিলেন সিদ্দিক। কিন্তু পরে মত বদলান। ক্যালিফোর্নিয়ার এক আফগান স্যাটেলাইট টিভি স্টেশনে ‘‘ডুরান্ড জিরগা শো’’ নামে একটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন তিনি। সেই অনুষ্ঠানের সুর পুরোপুরি তালিবান ও পাঠান জাতীয়তাবাদের। সেই সঙ্গে তা পাকিস্তান-বিরোধীও।
আফগান বংশোদ্ভূত মার্কিন এক সাংবাদিকদের মতে, সিদ্দিক মনোরোগী হতে পারেন। হয়তো তিনি নিজেকে আফগানিস্তানের নির্বাসিত সরকারের প্রধান বলে মনে করেন। কাবুলে ক্ষমতা দখলের স্বপ্নও হয়তো দেখছেন তিনি। ওমরও যে স্বাভাবিক ছিল না, এ দিন তা জানিয়েছেন তার প্রাক্তন স্ত্রী সিতোরা ইউসুফি। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, ওমর আইএস অনুগামী হলেও সমকাম বিদ্বেষ স্বাভাবিক। ওমরকে যে দু’বার জেরা করা হয়েছিল, তা আগেই মেনে নিয়েছে এফবিআই। তার পরেও কেন এমনটা ঘটল, সেই প্রশ্নটাই তুলছে ট্রাম্প শিবির। তদন্তে কী মিলবে সে পরের কথা, অরল্যান্ডো, মতিনের আফগান উৎস, মৌলবাদ নিয়ে তুমুল বিতর্ক আমেরিকা জুড়ে। ভোট পর্যন্ত ট্রাম্প তো এটাই চান!