উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন।
শক্তি হ্রাস পেলেও এখনও সক্রিয় ইসলামিক স্টেট (আইএস)। শেখ নিমর আল-নিমরের মৃত্যুদণ্ডের পরে সৌদি আরব আর ইরানের নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার শিয়া ও সুন্নি প্রধান দেশগুলি আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছে। ফলে আদৌ আইএস দমন করা সম্ভব কি না তা নিয়ে চিন্তিত বিশ্ব। সোমবার পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়ে উত্তর কোরিয়া সেই পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে তুলল। এই নতুন সঙ্কটে কূটনৈতিক মহলে কার্যত ঝড় উঠেছে। নিন্দার পাশাপাশি কী ভাবে এই সঙ্কটের মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে ব্যস্ত কূটনীতিকরা। এর মধ্যেই চিন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের কূটনীতিকরা বৈঠকে বসেছেন। এ দিনই রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। তার উপরে উত্তর কোরিয়ার আবার দাবি, এ দিন হাইড্রোজেন বোমা ফাটানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এর ফলে নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। বিশেষ করে ইরানের সঙ্গে পাঁচ পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের সমঝোতায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক পরীক্ষা।
আরও পড়ুন- হাইড্রোজেন বোমা ফাটাল উত্তর কোরিয়া
পরমাণু বোমার কাছে দানব হাইড্রোজেন বোমা!
২০১১-য় বাবা কিম জং ইল-এর মৃত্যুর পরে উত্তর কোরিয়ার সর্বময় কর্তা হন ছোট পুত্র উন। আশা ছিল, পশ্চিমে শিক্ষিত (সুইজারল্যান্ড) উন দীর্ঘ দিনের নির্বাসিত অবস্থা থেকে উত্তর কোরিয়াকে বের করে নিয়ে আসবেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হবে। আশা ছিল আমেরিকা-সহ পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নতির পথে হাঁটবেন উন। কিন্তু উন হাঁটলেন সম্পূর্ণ উল্টো পথে। নিজের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করতে বাবার অনুগত উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সরিয়ে দিতে থাকলেন। পদত্যাগে বাধ্য করা নয়, অনেকেরই মৃত্যুদণ্ড হল। ছাড়েননি নিজের কাকা চাং সং থেক কে। অভিযোগ, থেক-কে কুকুর লেলিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়। অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফ্ট বন্দুক দিয়ে হত্যা করা হয়, উত্তর কোরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন ইয়ং চোলকে। সব মিলিয়ে উনের ‘বিষ নজর’-এ পড়ে উচ্চপদস্থ প্রায় ৭০ জন কর্মচারীর প্রাণ গিয়েছে বলে অভিযোগ। একই সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধেও কড়া অবস্থান নেন উন। চিনের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি হয়।
উত্তর কোরিয়া যত বিচ্ছিন্ন হয়েছে, যত নেমেছে নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া, ততই নিজের অস্ত্রভাণ্ডারকে সম্বৃদ্ধ করেছে উত্তর কোরিয়া। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, উনের হাতে প্রায় ১২ লক্ষ সেনা আছে। রিজার্ভে রয়েছে ৭৭ লক্ষ সেনা। পাশাপাশি, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে ক্রমাগত শান দিয়েছে উত্তর কোরিয়া। ক্রমাগত ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা বাড়িয়ে গিয়েছে। কিম জং ইলের সময় থেকেই ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি নিয়ে সক্রিয় হয়েছে উত্তর কোরিয়া। শুধু ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন নয়, উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সেই প্রযুক্তি বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান-সহ নানা দেশ প্রতিবাদে মুখর হলেও ইলকে কেউ দমাতে পারেনি। নিরাপত্তা পরিষদ একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি ক্রমেই ভঙ্গুর হয়েছে। কিন্তু আয়ুধের সাধনা থেকে বিরত থাকেননি ইল।
২০০৩ থেকেই পারমাণবিক অস্ত্র হাতে থাকার কথা বলে আসছে উত্তর কোরিয়া। কিন্তু সে ভাবে কেউ বিশ্বাস করেনি। ২০০৬-এ বিশ্বের ভুল ভাঙে। সে বছরের অক্টোবরে প্রথম তিনটি পারমাণবিক বিস্ফোরণের কথা ঘোষণা করে উত্তর কোরিয়া। নড়চড়ে বসে বিশ্ব। নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে। কিন্তু নির্বাসিত উত্তর কোরিয়া যে আরও ভয়ঙ্কর তা বুঝতে পেরে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনায় মূল ভূমিকা নেয় আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান। কিন্তু সেই আলোচনা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি। ২০০৯-এ আলোচনা ছেড়ে বেরিয়ে যায় উত্তর কোরিয়া। সে বছরের মে-তে আবার পরমাণু পরীক্ষা চালায় উত্তর কোরিয়া। আবার নিষেধাজ্ঞা। বেশ কয়েক বছর বাদে আবার সুর নরম করে আলোচনার টেবলে আসে উত্তর কোরিয়া।
উত্তর কোরিয়ার রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হল এক বার কড়া হওয়া, আবার সুর নরম করা। ক্ষমতায় বসার এক বছরের মধ্যে, ২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে তৃতীয় বার পারমাণবিক পরীক্ষা চালান উন। এ বার পরমাণু অস্ত্রের আকার ছোট করতে সফল হয়েছে বলে জানায় উত্তর কোরিয়া। ফলে শুধু পরমাণু বোমা তৈরি নয়, তাকে ক্ষেপণাস্ত্রে ব্যবহারের উপযোগী করে ফেলেছে বলে উত্তর কোরিয়া দাবি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা প্রায় ৯ হাজার কিলোমিটার। ফলে আমেরিকার একটি অংশে হানা দিতে সমর্থ উত্তর কোরিয়া। ২০১৫-র মে-তে সাবমেরিন থেকে সফল ভাবে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করে উত্তর কোরিয়া। তখনই হাইড্রোজেন বোমা আছে বলে হুমকি দিয়েছিল তারা। এ দিনের বিস্ফোরণ সেই দাবির প্রমাণ বলে জানিয়েছে উত্তর কোরিয়া।
আজকের বিস্ফোরণ হাইড্রোজেন বোমার কি না তা নিয়ে নিশ্চিত নন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে কয়েক দিন লাগবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, শুধু নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে উত্তর কোরিয়াকে কি আদৌ দমন করা সম্ভব? নরম-গরমের রাজনীতি করে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়েই উত্তর কোরিয়া এত দূরে চলে আসার পরে কী হবে? তা হলে কী হবে উপায়? নিশ্চিত নন বিশেষজ্ঞরা। অনেকের মতে, আবার নতুন করে আলোচনার রাস্তা খুলতেই এই কড়া অবস্থান নিচ্ছে উত্তর কোরিয়া। কারণ, বরাবরের মতো এ বারের পরীক্ষার পরেও মার্কিন আগ্রাসনের অজুহাত খাড়া করেছে উত্তর কোরিয়া। আমেরিকার সঙ্গে সমানে সমানে কথা বলতে চায় উত্তর কোরিয়া। কিন্তু এখনও পর্যন্ত উত্তর কোরিয়াকে এমন ‘মর্যাদা’ দিতে রাজি নয় আমেরিকা।
এ দিনের পরীক্ষা চিনকেও অস্বস্তিতে ফেলেছে। উত্তর কোরিয়া নানা সমস্যায় চিনকে পাশে পায়। বহির্বিশ্বের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার কূটনৈতিক যোগাযোগ অনেকটাই চিনের হাত ধরে হয়। চিনের সাহায্যেই নানা সঙ্কটে উতরে গিয়েছে উত্তর কোরিয়া। এই ধরনের কোনও পরীক্ষা চালানোর বিরুদ্ধে ছিল চিন। তাই এই পরীক্ষার কড়া নিন্দা করেছে চিন। কিন্তু এর পরে চিন কী অবস্থান নেবে তা এখন পরিষ্কার নয়।
উত্তর কোরিয়ার পরীক্ষা ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতাকে দুর্বল করে দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতা সফল হতে এখনও বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হবে। সেখানে কোনও গোলমাল হলেই উত্তর কোরিয়ার উদাহরণ দেখিয়া ইরান পিছিয়ে আসতে পারে। শক্ত হতে পারে ইরানের মধ্যে সমঝোতা বিরোধীদের হাত। একই ভাবে এই সমঝোতার অন্যতম স্থপতি আমেরিকাও বিপদে পড়তে পারে। কারণ, আমেরিকায় এই সমঝোতার বিরোধীর সংখ্যা কম নয়। বিশেষ করে রিপাবলিকানরা প্রেসিডেন্ট হলে এই সমঝোতা বাতিল করে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ছাড়া ইরানের গতি থাকবে না। আর ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র এলে মধ্য এশিয়ার অস্থিরতা তীব্র হবে। ইজরায়েল, সৌদি আরব— এমনিতে সব বিষয়ে দুই মেরুতে থাকা দু’টি দেশই ওই পথে হাঁটতে পারে বলে আশঙ্কা। ফলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা অন্য মাত্রা নেবে।
এখনও আইএস দমনের কোনও সর্বসম্মত পরিকল্পনা তৈরি হয়নি। ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস দুর্বল হলেও তাদের বিষদাঁত এখনও অটুট। পাশাপাশি, সৌদি আরব আর ইরানের আকচাআকচিতে মধ্য এশিয়া সরগরম। তা উপরে গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক পরীক্ষা। আমেরিকা-সহ পশ্চিমী বিশ্বের কাছে বছরের শুরুতেই সঙ্কটের চাপ বহুগুণ বেড়ে গেল।