সোমবার বিকেলে নোত্র দাম ক্যাথিড্রাল।
বানাতে লেগেছিল দু’শো বছর। ৬৩ মিনিটের আগুনে প্রথমে ভেঙে পড়ল ক্যাথিড্রালের প্রধান ধাতব মিনারের চূড়া। ঘণ্টা চারেকের মধ্যে পুড়ে ছাই গোটা ছাদ। সাড়ে আটশো বছরেরও বেশি পুরনো সৌধটির এই বিপর্যয় পাল্টে দিল প্যারিসের আকাশ-ছবি।
সেইন নদীর ধারে গির্জাটির ৩০০ফুট উঁচু মিনারটি দেখা যেত বহু দূর থেকে। এক নির্দয় জাদুকর আগুনের জাদুকাঠি ছুঁইয়ে অদৃশ্য করে দিল সেই মিনারকে। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁর খেদোক্তি, ‘‘আমাদের প্রিয় নগরীর মুণ্ডচ্ছেদ করেছে কেউ!’’
কাল স্থানীয় সময় সন্ধে ৫.৫০-এ টের পাওয়া যায়, ক্যাথিড্রালে আগুন লেগেছে। ২৩ মিনিট ধরে আগুনের উৎসস্থল খুঁজে পায়নি দমকল। সৌধটির উপরের দিকের কাঠামো কাঠের তৈরি। ফলে হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। দমকলকর্মীরা দ্রুত এলাকা খালি করে দিলেও নদীর এ-পারে দাঁড়িয়ে শয়ে শয়ে মানুষ এই ধ্বংসলীলা দেখছিলেন। ঘণ্টাখানেক পার হয়েছে। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন দমকলকর্মীরা। কিন্তু আগুন কমছে কই? হঠাৎ জনতার মধ্যে থেকে একটা চাপা চিৎকার। ভেঙে পড়ছে গির্জার প্রধান মিনারটি!
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
মঙ্গলবার সকালে নোত্র দাম ক্যাথিড্রাল।
তার পরেও আরও ঘণ্টা চারেক দাউদাউ করে জ্বলেছে গির্জার উপরের অংশটি। পাঁচশো দমকলকর্মীর লড়াইয়ে অবশেষে আয়ত্তে আসে আগুন। এক জন দমকলকর্মী গুরুতর জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ক্যাথিড্রাল ও সংলগ্ন এলাকাটি অতি দ্রুত খালি করে দেওয়ায় এড়ানো গিয়েছে প্রাণহানি। দশ ঘণ্টা পরে জানানো হয়, পুরোপুরি নিভেছে আগুন। মূল কাঠামোটি প্রায় অক্ষত রয়েছে। রক্ষা পেয়েছে ক্যাথিড্রালের বিখ্যাত বেল টাওয়ার দু’টিও। এখনও পর্যন্ত অনুমান, সংস্কারের কাজ থেকেই কোনও ভাবে আগুন লেগে যায়।
ক্যাথিড্রালের পুনর্নির্মাণের জন্য বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের আর্জি জানান প্রেসিডেন্ট মাকরঁ। সাড়াও মিলেছে বিপুল। ইতিমধ্যেই কয়েকশো কোটি ইউরো সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ধনকুবেররা। মঙ্গলবার সকালেই পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে ৭০ কোটি ডলার দিয়েছেন তিন ফরাসি শিল্পপতি। সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন অ্যাপল সংস্থার সিইও টিম কুক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক।
১১৬০ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয়। ১১৬৩ থেকে ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তৈরি হয়। প্রধান মিনার ৩০০ ফুট উঁচু গির্জার সবচেয়ে বড় ঘণ্টা ‘ইমানুয়েল’-এর ওজন ১৩ টন বিশাল অর্গ্যানে রয়েছে ১১৫টি ‘স্টপ’, ৫টি কি-বোর্ড, ৮ হাজারের বেশি পাইপ সিসার তৈরি ছাদে রয়েছে ১৩২৬টি টুকরো, ০.২ ইঞ্চি চওড়া প্রতি টুকরোর ওজন ২১০ টন গির্জার ছাদ তৈরির সময়ে ৫২ একর জমির গাছ কাটা হয়েছিল। প্রতিটি কড়ি-বরগা তৈরি হয়েছিল এক একটি গাছ দিয়ে। প্রতিটি স্তম্ভ ২২৬ ফুট উঁচু। ৩৮৭টি সিঁড়ি রয়েছে প্রতি স্তম্ভে। প্রতি বছর গির্জায় আসেন ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ। স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ৫০ মিনিট নাগাদ প্রথম ধোঁয়া দেখা যায় চূড়ার নীচে। ৬৩ মিনিট পরে ভেঙে পড়ে চূড়া। ২০১৪ সালের হিসেব অনুযায়ী, গির্জার সংস্কারের আনুমানিক খরচ ১২.৯৫ কোটি ইউরো।
এখন এই বিপুল সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও নোত্র দামের সংস্কারের জন্য কিন্তু বহু দিন হন্যে হয়ে ঘুরেছেন প্রেসিডেন্ট মাকরঁ। ফরাসি বিপ্লবের পরে মাত্র এক বার গির্জাটির ভাল মতো সংস্কার হয়েছিল। তার পর এত দিন আর বিশেষ কাজ হয়নি। সংস্কারের আশু প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ফরাসি সরকার কিছুতেই প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করে উঠতে পারছিল না। অবশেষে গত বছর শুরু হয় সংস্কারের কাজ। স্ক্যাফোল্ডিং, অর্থাৎ ভারায়, ঘিরে দেওয়া হয় ছাদের চারপাশটা।
আগুন গোটা ছাদটাকে গিলে নেওয়ার পরে এখন গির্জার উপরের দিকে সেই লোহার ভারাটাই রয়ে গিয়েছে। প্রাণহীন কঙ্কালের মতো।
ছবি: এপি এবং এফপি।