ম্যাকনট দামিনি
নিজেদের কর্মকৌশল পাল্টাচ্ছে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। এ দেশের তথ্য জোগাড় করতে তারা যে সুন্দরী মহিলাদের ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করছে, তার প্রমাণ মিলল হাতেনাতে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলির দাবি, এর আগেও এই পদ্ধতিকে কাজে লাগানো হয়েছে। তবে সোমবার বায়ুসেনার এক অফিসারকে গ্রেফতারের পর জানা গিয়েছে, ফেসবুক-হোয়াট্সঅ্যাপের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট এবং অ্যাপসে যৌন-প্রেমের ফাঁদ পেতে আইএসআই কব্জা করতে চাইছে গোপন তথ্য।
ভারতীয় বায়ুসেনার ওই অফিসারের নাম রঞ্জিত কে কে। তিনি মুখ্য এয়ারক্র্যাফ্ট ইঞ্জিনিয়ার (লিড এয়ারক্র্যাফ্ট ম্যান) পদে কাজ করেন। অর্থাত্ তাঁর তত্ত্বাবধানে বায়ুসেনার এয়ারক্র্যাফ্ট রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আইএসআইয়ের কাছে পাচার করার অভিযোগে গত সোমবার তাঁকে দিল্লিতে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হয়েছিল, তিনি টাকার লোভেই ওই তথ্য বিক্রি করেছেন। কিন্তু, তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, মোবাইলের বেশ কিছু ভিডিও এবং অডিও ফাইল পরীক্ষা করে জানিয়েছেন ঘটনাটা ঠিক তেমন নয়।
তবে ঠিক কি হয়েছে রঞ্জিতের সঙ্গে?
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, ওই অফিসার আসলে আইএসআইয়ের পাতা প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে বড়সড় চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। যা হার মানায় রোমাঞ্চকর উপন্যাসকেও। কী রকম?
বছর তিনেক আগে ফেসবুকে এক তরুণীর কাছ থেকে বন্ধুত্ব স্বীকারের অনুরোধ পেয়েছিলেন রঞ্জিত। ম্যাকনট দামিনি নামের ওই সুন্দরীর সেই আবেদনে সাড়াও দেন তিনি। এর পর ধীরে ধীরে বন্ধুত্বের গভীরতা বাড়তে থাকে। গোয়েন্দাদের কাছে রঞ্জিত জানিয়েছেন, প্রতি দিন রাতেই কথা হত ম্যাকনটের সঙ্গে। আস্তে আস্তে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যৌনতা চলে আসে। রাতের পর রাত জেগে ম্যাকের সঙ্গে গল্পেই মশগুল থাকতেন বছর তিরিশের রঞ্জিত। এ জন্য নিজেকে ভাগ্যবানও মনে করতেন। কারণ, ম্যাকের সৌন্দর্যের দাপট! ব্রিটিশ ওই মহিলার সঙ্গে মশলাদার গল্প তাঁকে রূপকথার রাজ্যে নিয়ে যেত। দিনের বেলাতেও সারা ক্ষণ অনলাইন থাকতেন রঞ্জিত। কখন ম্যাক আসবে! আর সে এলেই কল্পনার দুনিয়ায় পাড়ি। চলছিল এ ভাবেই।
পড়ুন: ‘মধুর ফাঁদ’ পাততে দু’বছরে ৯০০ সুন্দরীকে প্রশিক্ষণ আইএসআইয়ের
পড়ুন: বায়ুসেনার মধ্যে পাকিস্তানের চর!
এর পরে সম্পর্কের স্তর পাল্টাতে থাকে। ফেসবুক চ্যাট থেকে হোয়াট্সঅ্যাপে নতুন আঙ্গিকে আলাপচারিতা শুরু হয়। টেক্সট থেকে এ বার তাঁরা অডিও-ভিডিও চ্যাট করা শুরু করেন। ম্যাকের খাঁটি ব্রিটিশ উচ্চারণ রঞ্জিতকে আরও মুগ্ধ করে। একান্ত গোপন ছবি, সেল্ফির আদানপ্রদান শুরু হয়। সম্পর্ক জমে ওঠে! আর সেই সময়েই এক দিন প্রস্তাবটা পেড়ে ফেলেন ম্যাক।
বিস্টনের বাসিন্দা ম্যাক ব্রিটিশ একটি ম্যাগাজিনে কাজ করে বলে পরিচয় দিয়েছিল। সেই পত্রিকায় লিখবে বলে তাঁর ‘বন্ধু’র কাছে ভারতীয় বায়ুসেনা সম্পর্কে জানতে চায় ম্যাক। আগেও তাঁর কাজের ধরণ নিয়ে ম্যাকের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন রঞ্জিত। কিন্তু, এ ভাবে ‘লেখা’র প্রসঙ্গ আসায় তিনি কিছুটা থমকে যান। ম্যাক এ বার জানান, তথ্যের বিনিময়ে রঞ্জিত কিছু টাকাও পেতে পারেন। পরিস্থিতি বুঝে কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য তিনি ম্যাককে জানান। কিন্তু, তাতে দমবার পাত্রী নন ম্যাক। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তিনি এ বার গ্বালিয়রের ‘ট্যাকটিক্যাল অ্যান্ড কমব্যাট ডেপ্লয়মেন্ট এস্টাবলিশমেন্ট’ (টিএসিডিএ) সম্পর্কে জানতে চান। রঞ্জিত যদিও সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, তিনি জানতেন ভারতীয় বায়ুসেনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ওই ইউনিটটি!
ম্যাককে ‘না’ বলায় যেন মিসাইল ধেয়ে আসে তাঁর দিকে। হুমকি দেওয়া হয়, তথ্য না দিলে আগে পাঠানো ভিডিও, অডিও, টেক্সট সব ফাঁস করে দেওয়া হবে। ঘাবড়ে যান রঞ্জিত। ম্যাক কি বলছে! কী করবেন ভেবে পান না ওই ইঞ্জিনিয়ার। তত ক্ষণে তিনি বুঝতে পেরেছেন, তিনি আইএসআইয়ের পাতা ‘হানিট্র্যাপ’-এর শিকার। ম্যাকনটি দামিনি নামে আদতেও কেউ নেই হয়তো। ভুয়ো নামে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে, যৌন-প্রেমের ছলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করতে চেয়েছিল সে। আর পেছনে ছিল আইএসআই। রঞ্জিতের দাবি, তথ্য ফাঁস না করে তাঁর আর কোনও উপায় ছিল না।
কাজের সুবাদে রঞ্জিতকে ঘন ঘন বেলগাঁও থেকে চেন্নাই যাতায়াত করতে হত। কখনও কখনও দিল্লিতে। শেষে দিল্লিতে এক আইএসআই এজেন্টের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। যখন যেখানেই গিয়েছেন, আইএসআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল অবিচ্ছিন্ন— কখনও ফেসবুকে, কখনও হোয়াট্সঅ্যাপে, কখনও বা স্কাইপিতে।
গোয়েন্দাদের দাবি, বেলগাঁও থেকে তিন বার, চেন্নাই ও দিল্লি থেকে ছয় বার রঞ্জিত বায়ুসেনার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করেছেন। এয়ারক্র্যাফ্ট উড়ানের পাশাপাশি বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ডেপ্লয়মেন্টের গোপন সংবাদ তিনি পাচার করেছেন। এমনকী, আইএসআইয়ের কাছে মিরাজ এবং ফাইটার জেটের সব খবরও ফাঁস করে দিয়েছেন। ওই তথ্য বাহিনীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সেনা গোয়েন্দা এবং দিল্লি পুলিশ যৌথ ভাবে রঞ্জিতকে গ্রেফতার করে। এর পরেই বায়ুসেনার চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় তাঁকে। দিল্লি পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছেন, আপাতত ইলেকট্রনিক সারভেলিয়্যান্স পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। সেই কারণে রঞ্জিতকে ফের দিল্লি নিয়ে আসা হয়েছে। এই শহরেই ম্যাকের সঙ্গে তাঁর বর্ষবরণের রাত কাটানোর পরিকল্পনা ছিল।