হাহাকার: ইন্দোনেশিয়ার পাংকাল পিনাং-এর বিমানবন্দরে কান্না স্বজনহারার। ছবি: রয়টার্স।
লায়ন এয়ার-এর দুর্ঘটনাগ্রস্ত জে টি ৬১০ বিমানটিতে ওঠার কথা ছিল ইন্দোনেশিয়ার সোনি সেটিয়াওয়ানের। কিন্তু যানজটের জন্য বিমান ধরতে পারেননি তিনি। এখন ঈশ্বরকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ দিচ্ছেন। পরিবারও দুর্ঘটনার কথা শুনে ভেঙে পড়েছিল। সোনির কথায়, ‘‘কান্নাকাটি শুরু হয়ে গিয়েছিল। মাকে সামলানো যাচ্ছিল না। তার পরেই ওদের জানালাম, আমার কিছু হয়নি।’’
দুর্ঘটনার খবর মিলতেই জাকার্তা এবং পাংকাল পিনাং-এর বিমানবন্দরে ভিড় জমান যাত্রীদের শোকার্ত স্বজন। এক তরুণী বিমানবন্দরে ঢোকার সময়েই কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘‘ধৈর্য ধরো। বাবার জন্য প্রার্থনা করো।’’ সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলে যান তিনি।
উদ্ধারকারীরা জানিয়েছেন, বিমানের লেজের দিককার ধ্বংসস্তূপের খোঁজ মিলেছে। মূল কাঠামোর জন্য তল্লাশি চালানো হচ্ছে। জাভা সাগরে প্রচণ্ড স্রোত এবং উঁচু ঢেউয়ে উদ্ধারকাজেও সমস্যা হচ্ছে। নামানো হয়েছে সমুদ্রের তলায় কাজ করে এমন রোবটও। প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো এখন জোর দিচ্ছেন উদ্ধারকাজেই।
বছরের আতঙ্ক
• ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮: মস্কো বিমানবন্দর থেকে ওড়ার কয়েক মিনিটের মাথায় ভেঙে পড়ে সারাতভ সংস্থার বিমান। মৃত ৭১। রাশিয়ার ওরস্ক শহরে যাচ্ছিল বিমানটি।
• ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮: তেহরান থেকে ইয়াসুজ যাওয়ার পথে ইরানের জ়াগরস পর্বতে ভেঙে পড়ে অসেমন সংস্থার বিমান। মৃত ৬৬।
• ১২ মার্চ, ২০১৮: কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের মাটি ছোঁয়ার কয়েক মুহূর্ত আগে ভেঙে পড়ে বাংলাদেশি সংস্থা ইউএস-বাংলা-র বিমান। মৃত ৪৯। বেঁচে যান ২২ জন।
• ১১ এপ্রিল, ২০১৮: আলজিরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স থেকে ওড়ার কিছু পরেই ভেঙে পড়ে সামরিক বিমান। মৃত ২৫৭।
• ১৮ মে, ২০১৮: হাভানার বিমানবন্দর থেকে ওড়ার কিছু পরে ভেঙে পড়ে বোয়িং ৭৩৭। মৃত ১১২ জন। বেঁচে যান ১ জন।
ইন্দোনেশিয়ায় আগে
• ১৬, অগস্ট, ২০১৫: পাপুয়ায় ভেঙে প়ড়ে ইন্দোনেশীয় সংস্থা ত্রিগানা এয়ারের বিমান। মৃত ৫৪।
• ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৪: ইন্দোনেশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর যাওয়ার পথে জাভা সাগরে ভেঙে পড়ে এয়ার এশিয়ার বিমান। মৃত ১৬২।
সস্তার বিমান সংস্থা লায়ন এয়ার-এর সিইও এডওয়ার্ড সিরেট জানিয়েছেন, ওড়ার আগের রাতেই সমস্যা দেখা দিয়েছিল প্রায় নতুন বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স ৮-এ। আগের দিন বালি দ্বীপ থেকে জাকার্তার
জন্য উড়েছিল এটি। তখনই প্রযুক্তিগত সমস্যা ধরা পড়ে। গত অগস্টে বিমান সংস্থার হাতে এসেছিল এটি। তার পর থেকে ৮০০ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়েছে বোয়িং ৭৩৭। সিইও-র দাবি, রাতেই ইঞ্জিনিয়াররা ওই বিমানটি পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। মেরামতির পরে তাঁরা জানান, জে টি ৬১০ ওড়ার জন্য তৈরি। এর পরে পাইলটও পদ্ধতি মেনে সব পরীক্ষা করে দেখেন। পাইলটরা মাদক নিয়েছেন কি না, দেখা হয়েছিল তা-ও। এ দিন আবহাওয়াও পরিষ্কার ছিল। তার পরেও ঠিক কী কারণে ভেঙে পড়ল এটি, এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এই সংস্থার বিমান আগেও বেশ কয়েক বার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে।
আজ দুর্ঘটনার জেরে লায়ন এয়ার–এর বিমানে দেশের সরকারি অফিসারদের না ওঠার নির্দেশ দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। বস্তুত ২০০৭ সালের জুলাই থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কালো তালিকায় ছিল এই সংস্থা। দু’বছর আগে, জুন মাসে সে তালিকা থেকে সরানো হয়েছে সংস্থাটিকে। নিরাপত্তাজনিত কারণে ইইউ-এর আকাশ-পথেও এই সস্তার বিমান সংস্থা নিষিদ্ধ ছিল। ইন্দোনেশিয়ার আরও ৫১টি সংস্থা এই তালিকায় আছে। একের পর এক দুর্ঘটনায় পড়া ইন্দোনেশীয় বিমান উদ্বেগ বাড়িয়েছে গোটা বিশ্বের।
দ্বীপ-ঘেরা এই দেশে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে বিমান। তা সত্ত্বেও একাধিক বিমান-দুর্ঘটনার সাক্ষী এই দেশ। কেন এখানে নিরাপত্তা সংক্রান্ত খুঁটিনাটিতে নজর দেওয়া হয় না, প্রশ্ন উঠেছে বারবার। সস্তার সংস্থা হলেও লায়ন এয়ার গত কয়েক বছরে চাহিদার কারণে পরিষেবা বাড়িয়ে তুলেছে কয়েক গুণ। কিন্তু কখনও বিমান ভেঙে পড়ে, কখনও অন্য সংস্থার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়েছে লায়ন এয়ার–এর বিমান। আজ এ বছরের সব চেয়ে ভয়াবহ বিমান-দুর্ঘটনার পরেও কি হুঁশ ফিরবে? জানতে চান স্বজনহারা মানুষ।