ভারত কি এই তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে? ফাইল চিত্র
আগামী দু’দিনের মধ্যে আফগানিস্তানে সরকার গড়ার প্রক্রিয়া শেষ হবে বলে জানিয়েছে তালিবান। দোহায় চলছে এই নিয়ে আপৎকালীন সক্রিয়তা। মেশিনগান পাশে রেখে তালিবান নেতারা আপাতত আলোচনার টেবিলে। সে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিনিধির সঙ্গে চলছে কথাবার্তা।
ভারত কি এই তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে? দিলেও, ভারতের কূটনীতির প্রশ্নে নতুন দৌত্য কত দূর সফল হবে? ভারতের প্রতিবেশী বলয়ে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশ, হয় ইতিমধ্যেই আসন্ন তালিবান জমানার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে রেখেছে, নয় তো সম্পর্ক তৈরিতে উদ্যত। এই বিষয়টি কি উদ্বেগের নয় ভারতের কাছে? ভারত কি ইতিমধ্যেই ব্যাক চ্যানেলে কথাবার্তা চালু করে দিয়েছে তালিবানদের সঙ্গে?
সাউথ ব্লকের শীর্ষ সূত্রে বলা হয়েছে, “তালিবান সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কী হবে, তা বলার মতো সময় এখনও আসেনি। আমরা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি। অন্যান্য দেশ কী ভাবে চলে সেটাও দেখছি। কিন্তু প্রতিটি দেশের অবস্থান, সমস্যা এবং কূটনৈতিক শর্ত পৃথক। তালিবানকে নিয়ে আমাদের সমস্যা জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত। ফলে আমাদের গভীর ভাবে সব দিক বিবেচনা করে তবেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
কোন দিকে চলছে এই ‘ভাবনার’ গতি? বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, আফগানিস্তানে আটকে পড়া ভারতীয়দের ফিরিয়ে নিয়ে আসা নিয়ে দর কষাকষি শুরু হওয়া মাত্রই, কথাবার্তা শুরু হয়েছে তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে। সূত্র মারফত এটাও জানা গিয়েছে, নিরাপদে ভারতীয় কর্তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য ‘বিনিময় মূল্য’ও দিতে হয়েছে। পাশাপাশি এ কথাও জানা গিয়েছে, তালিবানের সরকার গড়া নিয়ে নয়াদিল্লির সঙ্গে কোনও আলোচনা না-হলেও সূত্র মাধ্যমে ভারত তাদের দাবিগুলি বাতাসে ভাসিয়েছে। ভারত চায়, ৯৬ সালে মোল্লা ওমরের মতো শুধুমাত্র পশতুনদের সরকার যেন না হয়। আফগানিস্তানের সমস্ত সম্প্রদায়ের (তাজিক, উজবেক, হাজারা ইত্যাদি) প্রতিনিধিত্ব যেন থাকে সরকারে। সূত্রের মতে, নয়াদিল্লি মনে করছে সে ক্ষেত্রে সামান্য হলেও ভবিষ্যতে দর কষাকষির পরিসর থাকবে ভারতের। সাউথ ব্লকের দাবি, বিগত দু’দশক ধরে ভারত সে দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য যে সামাজিক এবং পরিকাঠামো প্রকল্প তৈরি করেছে, তার ফলে সার্বিক ভাবে ভারত সম্পর্কে একটা ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে।
পাশাপাশি এটাও চাওয়া হচ্ছে— আগের কট্টরপন্থী অবস্থান লঘু করে সরকারকে কিছুটা সভ্য ও আধুনিক চেহারা যেন দেয় তালিবান নেতৃত্ব। নারী-অধিকার, মানবাধিকার এবং সংবাদমাধ্যম সংক্রান্ত বিষয়গুলিতে ১৯৯৬-এর পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, এ কথা রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকেও বলেছে নয়াদিল্লি। তালিবান সরকার গঠন নিয়ে যাঁদের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে, তাদের মধ্যে দু’জন ভারতের ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত। এক জন দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, অন্য জন শান্তি আলোচনার অন্যতম আহ্বায়ক আবদুল্লা আবদুল্লা। তাঁদের মাধ্যমেই ভারত নিজেদের বার্তা পাঠিয়েছে বলে খবর। আজই কারজাইয়ের সঙ্গে দোহায় তালিবান নেতাদের দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে।
তবে এ কথা দিল্লি বিলক্ষণ জানে, তাদের ইচ্ছানুসারে একটি পাতাও নড়বে না আফগানিস্তানে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, আসন্ন আফগান সরকার সম্পর্কে কী অবস্থান নেওয়া হবে? সূত্রের বক্তব্য, পাকিস্তানের সঙ্গে যে রকম মাঝামাঝি কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখা হয়েছে, তেমন ভাবে চলা হতে পারে। সরকারকে একেবারে অস্বীকার করা হবে না, নিয়মমাফিক ভারতীয় দূতাবাসও থাকবে। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক বিনিময় হবে শর্তসাপেক্ষ এবং সীমিত ক্ষেত্রে, যে কোনও সময়ে যা প্রত্যাহার করে নেওয়া চলে।
ভারতের উদ্বেগের বড় কারণ চিন এবং রাশিয়া তালিবানের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। এই দুই দেশই প্রকারান্তরে পাকিস্তানের হাত শক্ত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। চিন এবং রাশিয়া শুধু নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যই নয়, তাদের যে কোনও পদক্ষেপই ভারতের বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
গত মাসেই বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মস্কোয় গিয়ে রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রীকে বলেছিলেন, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তালিবানের ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেওয়া যায় না। কিন্তু ভারতের কথা যে ভাবে উড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়া, তা নয়াদিল্লির কাছে চিন্তার।
অন্য দিকে তালিবান যদি আমেরিকায় হামলা না করার ব্যাপারে কথা দেয়, তা হলে উপমহাদেশ নিয়ে কোনও মাথাব্যথাই থাকবে না বাইডেন প্রশাসনের। সম্প্রতি বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে আফগান-নীতি নিয়ে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। তিনি কোয়াড বা চতুর্দেশীয় সংস্থার কথা তুলে বলেছেন, “ভারতের সঙ্গে আমেরিকার স্বার্থ পূর্বে মিলে যায়। কিন্তু পশ্চিমে মতবিরোধ রয়েছে।” অর্থাৎ তাঁর বক্তব্য, পূর্ব এশিয়া বা চিন সংক্রান্ত নীতির প্রশ্নে আমেরিকা পাশে থাকলেও পশ্চিম এশিয়া অর্থাৎ কাবুল প্রশ্নে আমেরিকা আর নেই
ভারতের সঙ্গে।