হাসপাতালে ইমরান। রয়টার্স
লাহোর থেকে ইসলামাবাদ পর্যন্ত ‘হকিকি আজ়াদি মার্চ’ (প্রকৃত স্বাধীনতার মিছিল)-এর ডাক দিয়েছিলেন তিনি। সেই মিছিলই চলাকালীনই বৃহস্পতিবার পাক পঞ্জাবের ওয়াজ়িরাবাদে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় আততায়ী। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান অবশ্য পায়ে গুলি লাগায় বেঁচে গিয়েছেন। তবে তিনি নিজের ও দলের রাজনৈতিক সংগ্রামকে আওয়ামী লীগের নেতা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তুলনা করলেন।
অবশ্য পাক গোয়েন্দার একটি সূত্রের দাবি, ইমরানের বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র করা হয়নি। হামলার বিষয়টি সাজানো। নির্বাচনের উদ্দেশে সম্ভবত পিটিআই-ই এই পরিকল্পনা করেছিল।
হামলার ঠিক এক দিন পরে ইমরানের কথায় অবশ্য উঠে এসেছে পূর্ব পাকিস্তানের প্রসঙ্গ। পিটিআই চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘পূর্ব পাকিস্তানে কী হয়েছিল? নির্বাচনে জয়ী দলের বিরুদ্ধে সেনা পদক্ষেপ করেছিল।’’ মুজিবের দলকে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল বলেও জানিয়েছেন ইমরান।এরই সঙ্গে পিটিআই প্রধান জানান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার (১৯৭১) ১৮ বছর পরে সেখানে ভারতের বিরুদ্ধে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে গিয়েও দেখেছিলেন স্টেডিয়ামে উপস্থিত ৫০ হাজার বাংলাদেশি পাকিস্তানের সমর্থনে গলা ফাটাচ্ছেন। অথচ ’৭১-এ পাকিস্তানের উপর গোটা বাংলাদেশের এক রাশ ঘৃণা ছিল।
ইমরানের কথায়, ‘‘সেই সময়ে উপলব্ধি করেছিলাম, ওদের সঙ্গে কতটা অবিচার করেছিলাম আমরা। ওরা (বাংলাদেশি) আমাদের ছাড়তে চায়নি কিন্তু আমরা ওদের প্রতি ন্যায়বিচার করিনি।’’এর পরেই পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমান সময়ে তাঁর ও তাঁর দলের পরিস্থিতির সাযুজ্য তুলে ধরেছেন ইমরান। তাঁর কথায়, ‘‘সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এখন। দেশের সব চেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের উপরে চাপ তৈরি করা হচ্ছে। চেষ্টা করা হচ্ছে সেই দলের নেতাকে হত্যা করার।’’
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ অবশ্য মনে করছেন, শেখ মুজিবের সঙ্গে তুলনা করে নিজেকে মহিমান্বিত করতে চাইলেও প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন অবস্থা এবং পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির কোনও তুলনাই চলে না। একই ভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের লড়াইয়ের সঙ্গেও ইমরানের তুলনাও বাড়াবাড়ি বলেই মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট অনেক বৃহৎ। সেই লড়াইয়ে ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু পাকিস্তানে ইমরানের লড়াই স্রেফ রাজনৈতিক। ইতিমধ্যেই ইমরান দাবি করেছেন, তাঁর উপরে হামলার নেপথ্যে রয়েছেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ, অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী রানা সানাউল্লা এবং আইএসআইয়ের ডিজি-সি মেজর জেনারেল ফয়জ়ল নাসির।গত কাল পিটিআই কর্মী-সমর্থকদের প্রতিবাদ আন্দোলনে ফের উত্তাল হয়ে ওঠে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর। প্রধানমন্ত্রী শরিফ-সহ তিন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ইস্তফার দাবিও তুলেছে পিটিআই।
বর্তমানে লাহোরের শওকত খানুম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইমরান। সেখান থেকেই তিনি বলেন, “লং মার্চে বেরোনোর সময়েই আমি জানতাম, ওরা আমাকে খুনের চেষ্টা করবে... দ্রুত ফের রাস্তায় নামব। ইসলামাবাদ পর্যন্ত মিছিলও করব।”তাঁর উপরে নজরদারির চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন ইমরান। এ ক্ষেত্রেও ত্রয়ীকেই (শরিফ, সানাউল্লা, ফয়জ়ল) নিশানা করেছেন। আইএসআইয়ের ডিজি-সি মেজর জেনারেল ফয়জ়ল নাসিরকে উদ্দেশে জানিয়েছেন, ওই জেনারেল দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সেনাপ্রধানকে অবিলম্বে পদক্ষেপ করার বার্তাও দিয়েছেন। তাঁর ‘লং মার্চ’-এ উদ্বিগ্ন হয়েই হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল বলে দাবি ইমরানের। এ ক্ষেত্রে সরকারি আধিকারিকদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছেন বলেও দাবি করেন। ইমরানের কথায়, ‘‘ওরা চেয়েছিল, আমার হত্যার কারণ হিসাবে ধর্ম তুলে ধরতে।’’
এর পরেই সেনার মর্যাদা রক্ষায় উপযুক্ত পদক্ষেপ করার আবেদন জানিয়েছেন সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার কাছে।এক জন পদস্থ সেনা আধিকারিকের বিরুদ্ধে এ ভাবে আঙুল তোলায় ইমরানের বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনি পদক্ষেপ করার জন্য পাকিস্তান সেনার তরফে সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। পাক সেনার ডিজি আইএসপিআর মেজর জেনারেল বাবর ইফতিকার জানিয়েছেন, পিটিআই চেয়ারম্যানের সমস্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। পাকিস্তান সেনা শৃঙ্খলাপরায়ণ ও পেশাদার। কারও উদ্দেশ্যপূরণের স্বার্থে যদি সেনার সম্মান, মর্যাদা ও সুরক্ষা ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করা হয়, সে ক্ষেত্রে সেনা নিজেদের অফিসারের পাশে থাকবে।
পাক গোয়েন্দার একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছে, ইমরানকে হত্যার কোনও ষড়যন্ত্র করা হয়নি। নির্বাচনকে মাথায় রেখে সম্ভবত পিটিআই-ই বরং ইমরানের উপরে হামলার নাটক রচনা করেছিল। ওই সূত্রটির দাবি, ইমরানের দু’টি বুলেট লেগেছে। তাঁকে যদি হত্যার চেষ্টাই করা হত, সে ক্ষেত্রে গুলি পায়ে নয়, তাঁর পাকস্থলি কিংবা বুকে লাগত।