একটু একটু করে ডুবছে, চোখের সামনেই। সাহায্যের হাত সঙ্কুচিত। তলিয়ে যেতেই দীর্ঘশ্বাস, যাঃ! সব শেষ! পতনের রেশ সুদূরপ্রসারী। তা ছায়া ফেলছে অর্থনীতিতে। উন্নয়নে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। শিল্প ও বাণিজ্যে এখন এমনটাই হচ্ছে। সূচনার পরেই অন্তিম পর্ব। মাঝে আর কোনও দৃশ্য নেই। সরকারি আর বেসরকারি-দুই ক্ষেত্রেই দুরাবস্থা লাগামছাড়া। স্বাভাবিক ভাবেই, বাংলাদেশ সরকারের চিন্তা বেড়েছে। এ ভাবে চলতে পারে না। কারণ খুঁজে, তার ঠিকঠাক দাওয়াইও দরকার। যথার্থ পরিচর্যায় রুগ্ন শিল্প চাঙ্গা হবেই। ফের মাথা তুলে সাফল্যের নিশান ওড়াবে। কাজ হারানোর ভয়ে শঙ্কিত শ্রমিক-কর্মচারিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন। তাঁরা অন্তত এটা বুঝবেন, সরকার তাঁদের ব্যাপারে উদাসীন নয়।
ক্ষতির খতিয়ান তত্ত্ব-তল্লাশ করে দেখা যাচ্ছে, একেবারে গোড়ায় গলদ! পরিকাঠামোতেই যাবতীয় ভুল। পরিচালন ব্যবস্থায় ত্রুটি। যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণের নামগন্ধ নেই। গাধা বোটের মতো ঠেলে ঠেলে যে ক’দিন চলার চলল। তার পরেই ডুবল। যার ভূত আছে, ভবিষ্যত নেই! অসুস্থতার পর চিকিৎসার চেয়ে প্রতিষেধক বেশি কাজের। এ বার সেই ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে। শিল্পের পালে হাওয়া লাগাতে করা হয়েছে সামগ্রিক পরিকল্পনা। সবার আগে কমানো দরকার ঋণের বোঝা। তাতেই কাবু শিল্প ও বাণিজ্য। ঋণের সুদ বাড়িয়েই যাচ্ছে ব্যাঙ্ক। সময় মতো পরিশোধ না করলে গলায় গামছা দিয়ে আদায়ের চেষ্টা। সহযোগিতার বদলে অসহযোগ!
ব্যাঙ্কের আচরণ বদলাতে হবে। তাদের প্রথম কাজ সুদ কমানো। সরকারি সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, কোনও ব্যাঙ্ক এক অঙ্কের বেশি সুদ নিতে পারবে না। সুদ হবে ১০ শতাংশের নিচে। সবচেয়ে বেশি হলে ৯ শতাংশ। তার ওপর উঠবে না। ঋণ আদায় করতেও পরিস্থিতি বিচার করতে হবে। এমন চাপ সৃষ্টি করলে হবে না, যাতে কোনও সংস্থা নুয়ে পড়ে। কারখানায় তালা ঝোলাতে হয়। ট্রেডিংয়ের চেয়ে ইন্ডাস্ট্রিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ে। বেসরকারি উদ্যোগের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। শিল্পোন্নয়নে তাদের ভূমিকাটাই বড়। সরকার আর কতটুকুই বা করতে পারে!
সরকারি সংস্থায় খরচ কমাতে, বেসরকারি খাতে উন্নয়ন বাড়াতে কমিটি তৈরি হয়েছে। যার নাম ‘প্রাইভেট সেক্টর ডেভেলপমেন্ট পলিসি কো-অর্ডিনেশন কমিটি’। যার সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর দফতরের মুখ্যসচিব। কমিটির বৈঠকে ঠিক হয়েছে, শুধু সুদ নয়, সার্ভিস চার্জও কমাতে হবে। রফতানি বাড়াতে ‘এলসি’ বা ‘লেটার অব ক্রেডিটে’র চার্জ কমবে। অ্যাকাউন্ট খোলা বা টাকা তোলার জন্য কোনও চার্জ নেওয়া চলবে না। নিলেও সেটা যেন খুব সামান্য হয়। এখন এক কোটি টাকার ‘এলসি’ করার চার্জ ৩ শতাংশ। এত বেশি নেওয়া যাবে না। এই চার্জ ০.২৫ শতাংশ থেকে এক শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে। ব্যাঙ্ক যে ‘সুইফট চার্জ’ নেয়, সেটাও বন্ধ হওয়া দরকার।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের এত বড় কেলেঙ্কারি সরকার জানল এত পরে!
ভাল গ্রাহকদের ‘বেনিফিট’ (সুযোগসুবিধা) দেওয়াটাও খুব জরুরি। কোনও সংস্থা পর পর তিন বছর নিয়মিত ভাবে কিস্তিতে কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করলে ‘সুগ্রাহক’ বলে বিবেচিত হবেন। তৃতীয় বছর থেকে তাঁর দেওয়া সুদের ১০ শতাংশ ছাড় পাবে। ১০০ টাকার জায়গায় দেবে ৯০ টাকা। তাদের আরও সুযোগসুবিধে বাড়ানোর কথা হচ্ছে।
নতুন শিল্পোদ্যোগীদের ঋণ দানের পরিমাণ এখনও যথেষ্ট কম। ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩তম। ব্যবসায় ব্যয়ের হিসেবে স্থান ১৭৪তম। এটা ভাল লক্ষণ নয়। এতে রফতানি মার খাচ্ছে। দেশে তৈরি জিনিসের দাম বিদেশ থেকে আমদানি করা জিনিসের চেয়ে অনেকটাই বেশি হয়ে যাচ্ছে। অবস্থা পরিবর্তনের জন্য ব্যাঙ্ক আর বিমা সংস্থাগুলোকে আরও দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। এক দিকে যেমন তাদের ঋণ দেওয়ার পরিমাণ বাড়ানো দরকার, অন্য দিকে তেমনই কী ভাবে উৎপাদনের খরচ কমে, তার ‘গাইডলাইন’ বানানোটাও খুব জরুরি। শিল্পায়নে বিদেশি বিনিয়োগ টানতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। বাজার অর্থনীতির দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক এব্যাপারে খুবই তৎপর।