মেয়ে লক্ষ্মীমন্ত কি না, পায়ের পাতা দেখে যাচাই করার চল ছিল এক সময়। দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে এখনও এই ধরনের ঘটনার কথা জানা যায়। নারীর রূপ-গুণের ‘মাপকাঠি’ নির্ণয়ের এই রীতি চলে আসছে বহু শতাব্দী ধরে। ধনী ঘরে বিয়ে দিতে নির্মম ভাবে মেয়েদের পা ছোট করে রাখার কুপ্রথা চালু ছিল প্রাচীন চিনেও।
৯৬০-১২৭৯ সালে সং বংশের রাজত্বকালে রাজ দরবারের নর্তকীদের মধ্যে প্রথম এই প্রথা চালু হয় বলে জানা যায়। তবে তার ঢের আগে, ৯৩৭-৯৭৫ সালে ট্যাং বংশের রাজত্বকালের লিখিত পুঁথিতেও এর উল্লেখ পেয়েছেন ইতিহাসবিদরা।
কথিত আছে, এক নর্তকীর সুন্দর, ছোট পা দেখে মোহিত হয়ে যান তৎকালীন রাজা। তার পর থেকেই ছোট পায়ের হিড়িক পড়ে যায়। অভিজাতদের মধ্যেও এই বিষয়টি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর ধনী পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিতে তা ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। পা ছোট হলে মেয়েদের আরও আকর্ষণীয় লাগে বলে ধারণা জন্মায় সকলের মধ্যে। তাই পায়ের দৈর্ঘ্য চার ইঞ্চির মধ্যে আটকে রাখার প্রথা শুরু হয়।
বাচ্চাদের হাড় যেহেতু নরম হয়, তাই তিন-চার বছর বয়স থেকেই মেয়েদের পা মুড়ে রাখার যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া শুরু হত। এর জন্য প্রথমে উষ্ণ ভেষজ ও পশুর রক্তে পা ভিজিয়ে রাখা হত, যাতে পা নরম হয়। কেটে ফেলা হত নখ। তার পর পায়ের আঙুলগুলি নীচের দিকে বাঁকিয়ে ভেঙে ফেলা হত।
হাড় ভাঙার যন্ত্রণায় বাচ্চারা কাতরাতে থাকলেও, সেই অবস্থাতেই শক্ত ব্যান্ডেজে মুড়ে ফেলা হত পা। ব্যান্ডেজ এমন ভাবে বাঁধা হত, যাতে ভাঙা হাড়া জোড়া লাগার কোনও অবকাশই না থাকে। আবার বিকৃত অবস্থায় পায়ের হাড় সোজাসুজি বাড়তেও না পারে।
এ ভাবেই মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলত। ব্যান্ডেজ বাঁধা বিকৃত পা নিয়েই যাবতীয় কাজকর্ম সারতে হত মেয়েদের, যা প্রায়শই বিপজ্জনক আকার ধারণ করত। পায়ের পাতার নীচে মোড়া অবস্থাতেই আঙুলের নখ বেড়ে গিয়ে তা পায়ের মাংস ফুঁড়ে ঢুকে যেত। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ত সংক্রমণ।
আবার রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গিয়ে পায়ে পচন ধরারও ঘটনা ঘটত অহরহ। কিন্তু এতেও রেহাই ছিল না। বরং তাতে খুশিই হতেন পরিবারের লোকজন। কারণ পায়ে পচন ঝরলে, আঙুল খসে পড়ে যাবে, তাতে পা আরও ছোট লাগবে। এর জন্য ব্যান্ডেজ বাঁধার সময় কেউ কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে কাপড়ের মধ্যে কাচের টুকরো বা আলপিন লাগিয়ে দিত যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পায়ে পচন ধরে।
এতে অনেক সময়ই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ত রক্তে। সেপটিক হয়ে মৃত্যুও হত কারও কারও। কিন্তু আঙুল ভাঙা, ব্যান্ডেজ বাঁধা ওই ছোট পা-কেই ‘সোনালী পদ্ম’-এর সঙ্গে তুলনা করা হত সেই সময়। মনে করা হত, পা যত শক্ত করে বাঁধা হবে, মেয়েদের যৌনাঙ্গও তত আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। তাতে সঙ্গমের সময় চরম আনন্দ পেতে পারবেন পুরুষরা। পুরুষের মন পেতে তাই মেয়েদের পা ছোট রাখতে বাধ্য করা হত।
ইতিহাস বলে, ১৯ শতকের গোড়ার দিকে চিনে মোট মহিলা জনসংখ্যার ৪০ শতাংশেরই পা ছোট ছিল। শুধুমাত্র অভিজাতদের মধ্যেই সংখ্যাটা ছিল প্রায় ১০০ শতাংশ। পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে ১৬৪৪ সাল থেকে। সেই সময় মাঞ্চু চিং বংশ ক্ষমতায় এলে পা ছোট করে রাখার কুপ্রথা নিষিদ্ধ হয়। তার বদলে নৌকোর মতো দেখতে উঁচু হিলের জুতো চালু হয়। তবে তখন এই প্রথা নিষিদ্ধ হয়েছিল শুধুমাত্র মাঞ্চু চিং বংশের মধ্যেই।
বিংশ শতকে এই নির্মম প্রথার বিরোধিতা করতে শুরু করেন মুসলিম এবং পশ্চিমী সমাজ সংস্কারকরা। তবে রাজতন্ত্রের অবসানের পর চিনে প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে, ১৯১২ সালে আইন করে পা ছোট করার কুপ্রথা নিষিদ্ধ হয়।
লুকিয়ে চুরিয়ে কেউ পা ছোট করছেন কিনা দেখতে সেই সময় সরকারের তরফে বেশ কিছু কর্মীও নিয়োগ করা হয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের পা পর্যবেক্ষণ করতেন তাঁরা। কিন্তু পায়ের তুলনমায় বড় জুতো পরেও কেউ কেউ তাঁদের চোখে ফাঁকি দিতেন।