তুরস্কের এই বিমানঘাঁটিতেই নাকি মজুত রয়েছে আমেরিকার পরমাণু অস্ত্র। —ফাইল চিত্র।
১৯৬২। অক্টোবরের মাঝামাঝি। শীত সমাগত প্রায়। কিন্তু ওয়াশিংটনে সোভিয়েত দূতাবাসে উষ্ণতা প্রখর গ্রীষ্মের মতো। বন্ধ ঘর। ভিতরে দু’দেশের প্রতিনিধি। সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত আনাতোলি ডোবরিনিন-এর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডি। সরকারি সাক্ষাৎ নয়। কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডির বার্তা বয়ে এনেছেন রবার্ট। সোভিয়েত দাবি মেনে ইতালি আর তুরস্ক থেকে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম জুপিটার ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেবে আমেরিকা। কিন্তু তা প্রকাশ্যে স্বীকার করা হবে না। আনাতোলি হয়ে এই সংবাদ পৌঁছে যাবে সোজা সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ক্রুশ্চেভের কাছে। বন্ধ হবে কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি তৈরির কাজ। ধীরে ধীরে সে ঘাঁটি ভেঙেও ফেলা হবে। আমেরিকাও কিউবা ঘিরে থাকা নৌবহর সরিয়ে নেবে। হাঁফ ছাড়বে ঘোটা দুনিয়া।
দুনিয়া কাঁপানো ১৩টি দিন (১৬ অক্টোবর-২৮ অক্টোবর)। কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি গড়া নিয়ে দুই মহাশক্তিধরের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ প্রায় শুরু হতে যাচ্ছিল। রুদ্ধশ্বাস দিন কাটাচ্ছিল গোটা দুনিয়া। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের দিকে জল না গড়ালেও সমাধান সূত্রটি লক্ষণীয়। প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও পরে জানা যায় শর্ত মেনে ১৯৬৩-র এপ্রিলের মধ্যে তুরস্ক এবং ইতালি থেকে জুপিটার ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নিয়েছে আমেরিকা। সেই ঠাণ্ডা যুদ্ধের আমল থেকেই তুরস্ক আমেরিকা তথা ন্যাটোর ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগী।
তার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় কেটে গিয়েছে। তুরস্কে সদ্য সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ করেছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। এবং তার পর এরদোগানের বজ্রমুষ্টিতে এখন হাঁসফাঁস করছে তুরস্ক। তিন মাসের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন তিনি। পাশাপাশি আমেরিকার সঙ্গে দর কষাকষি শুরু হয়েছে। আমেরিকায় আশ্রয় নেওয়া তুরস্কের ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনকে ফেরত চাই এরদোগানের। তিনিই না কি এই অভ্যুত্থানের নাটের গুরু। গুলেনকে তুরস্কের হাতে তুলে না দিলে আমেরিকার সঙ্গে তুরস্ক অসহযোগিতার রাস্তায় হাঁটবে বলেই প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এরদোগান। তুরস্কের যে বিমানঘাটি ব্যবহার করে সিরিয়ায় আইএস বিরোধী অভিযান চালাচ্ছে আমেরিকা, সেই ইনসিরলিঙ্ক বিমানঘাঁটিও আমেরিকার নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। ইনসিরলিঙ্ক বিমানঘাঁটির দায়িত্বে ছিলেন তুরস্ক বিমানবাহিনীর যে অফিসার, অভ্যুত্থানের অন্যতম চক্রী হিসেবে তাঁকে আটক করেছে এরদোগানের সরকার। আমেরিকা কিন্তু এরদোগানের এই সব কঠোর পদক্ষেপের বিরোধিতাই করছে। তুরস্ক-মার্কিন সম্পর্ক তাই আপাতত শীতল। আইএস বিরোধী অভিযানের ভবিষ্যত নিয়েও অনেকে চিন্তিত।
আরও পড়ুন: সীমান্তে এত ট্যাঙ্ক পাঠালে কিন্তু আটকাবে বিনিয়োগ, হুঁশিয়ারি চিনের
কিন্তু শুধু আইএস নয়, তুরস্ক নিয়ে চিন্তাটি আরও গভীরে। তার জন্য মার্কিন বায়ুসেনার ‘বাজেট’-এর দিকে চোখ রাখতে হবে। সেখানে দেখা যাবে বেলজিয়াম, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ড এবং তুরস্কে ‘স্পেশাল ওয়েপন’ মজুত রয়েছে। এই ‘স্পেশাল ওয়েপন’ হল আসলে পরমাণু অস্ত্র। আমেরিকা এই দেশগুলিতে পরমাণবিক অস্ত্র এবং ওই অস্ত্র ব্যবহারে সক্ষম বিমান রেখেছে। সেই ৬০-এর দশকেই ন্যাটোর অন্য সদস্য দেশগুলির সঙ্গে আমেরিকার চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুসারে তুরস্ক-সহ বেশ কিছু দেশ তাদের মাটিতে মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্র বা সেই অস্ত্র প্রয়োগে সক্ষম ব্যবস্থা রাখার অনুমতি দেয়। চুক্তি অনুযায়ী এই সব জায়গায় ‘বি৬১ নিউক্লিয়ার গ্র্যাভিটি’ বোমা মজুত থাকার কথা। এবং সেই অস্ত্রের দেখভাল করার কথা আমেরিকারই। তুরস্কের ইনসিরলিঙ্ক তেমনই একটি ঘাঁটি। তুরস্কে প্রায় ৯০টি মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্র মজুত রয়েছে বলে খবর।
ন্যাটো সূত্রে জানান গিয়েছে, ইনসিরলিঙ্কে মাটির নীচে বিমানের হ্যাঙ্গারে এই অস্ত্র মজুত রয়েছে। ১২ ফুট লম্বা বোমাগুলির ওজন ৭০০ পাউন্ডের মতো। এই ধরনের বোমা বহন করার জন্য ইনসিরলিঙ্কে এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন, এফ-১৫ই এবং এফ/এ-১৮ হর্নেট যুদ্ধবিমানও রয়েছে।
অর্থাৎ, জুপিটার ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেওয়া হলেও, তুরস্কে মার্কিন পরমাণু অস্ত্র এখনও রয়েছে। থাকার কারণও রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলেও রাশিয়ার পেশিশক্তি যে এখনও কতটা, তার ক্রিমিয়ায় প্রমাণিত হচ্ছে। আগেই চেচনিয়া এবং জর্জিয়া সে প্রমাণ আগেই পেয়েছে। সিরিয়ার হয়েও রণাঙ্গনে নেমেছে রাশিয়া। পুতিন আসলে ন্যাটোর প্রতিস্পর্ধী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগ্রহী। ফলে ন্যাটো তথা আমেরিকার কাছে তুরস্কের ইনসিরলিঙ্ক ঘাঁটি কৌশলগত ভাবে এখনও গুরুত্বপূর্ণ।
ইনসিরলিঙ্ক আমেরিকার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা এরদোগান জানেন। তাই তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টার পরের দিনই ইনসিরলিঙ্ককে বিদ্যুৎ ও জল বিছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। পরে তা চালু হয়েছে। কিন্তু এরদোগান সাময়িক অসহযোগিতার মাধ্যমে বার্তা দিতে চেয়েছেন, তুরস্কের দাবি আমেরিকা না মানলে ওই বিমানঘাঁটিটি নিয়ে টানাপোড়েন বাড়বে। তার চেয়েও বড় ভয় কিন্তু ইনসিরলিঙ্ক বিমানঘাঁটির নিরাপত্তা নিয়ে। অভ্যুত্থানের পরে তুরস্কের সেনার অবস্থা টালমাটাল। কখন কার উপরে কোপ নেমে আসে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় বিভিন্ন স্তরের সেনা কর্তারা। ফলে ইনসিরলিঙ্কে এখন কোনও নাশকতা বা জঙ্গিহানা হলে সেখানে মোতায়েন মার্কিন বাহিনী তুরস্কের সেনার সাহায্য কতটা পাবে, তা বলা শক্ত।
আইএস বা আইএস-এর মতো জঙ্গি সংগঠনগুলির তুরস্ক জুড়ে প্রভাব ছড়িয়েছে। এরদোগানের নরম মৌলবাদ এই জঙ্গি সংগঠনগুলিকে শিকড় ছড়াতে সাহায্য করেছে। ফলে ইনসিরলিঙ্ক বিমানঘাঁটিতে আইএস হানার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বড়সড় অঘটন ঘটলে জঙ্গিদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র চলে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। যদিও এই ধরনের পারমাণবিক অস্ত্রকে সক্রিয় করার কৌশল খুবই জটিল। নানা প্রযুক্তিগত ধাপও রয়েছে। তবুও আশঙ্কাটা থেকেই যাচ্ছে। তুরস্কের সঙ্গে আগামী দিনের দর কষাকষিতে আমেরিকাকে যথেষ্ট সাবধানেই পা ফেলতে হবে।