প্রতিমাকে সাজিয়ে নেওয়ার পালা।
দোল খাওয়া কাশ ফুল, শিশিরভেজা ঘাসে শিউলির সখ্য কিংবা তুলোট মেঘের পরিচিত অনুষঙ্গ হয়তো নেই। কিন্তু প্রবাসী মন আলো করে আছে আশ্বিনের রোদ্দুর। আকাশের দিকে তাকিয়ে সুর ভাঁজছে, বাজল তোমার আলোর বেণু।
সারা সপ্তাহ তুমুল ব্যস্ততা। নিজেদের কাজকম্মো তো আছেই। ছেলেমেয়েদেরও স্কুল শুরু হয়ে গিয়েছে। তবু অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ফক্স নিউজ কিংবা প্রিয় টেলি সিরিজ থেকে চোখ সরিয়ে ক’টাদিন নাটকের সংলাপ ঝালিয়ে নিচ্ছেন ব্যস্ত সফটঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকের স্ত্রীকে দেখা যাচ্ছে কিচেনে আপনমনেই খুন্তি হাতে নাচের মুদ্রায় মগ্ন। পুজোর শেষ দিনে নৃত্যনাট্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছেন তিনি।
ও দিকে অমুকদাদার বেসমেন্টে রয়েছে প্রতিমা। তার সাজসজ্জাও মানানসই করতে লেগে পড়েছেন কয়েকজন। ভটচাজ জেঠুর কোম্পানি তাঁকে বদলি করেছে ভিয়েনায়। অতএব এ বার পুরুতের ভূমিকায় ব্যানার্জি জেঠু। স্মরণিকা’র জন্য লেখা জমা পড়েছে বিস্তর। সে সব লেখাপত্তরেই চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন, যৌবনে কবিতা লেখা এখন সফল এগজিকিউটিভ সকলের প্রিয় দাদাটি। পুজো দু’দিনের মেনু আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছে। কর্মকর্তারা বোঝার চেষ্টা করছেন কতজন হতে পারে এ বার। ভেনু কখন পাওয়া যাবে তা নিয়েও ফাইনাল কথা বলতে হবে।
এমন টুকরো কথাই এখন ফিলাডেলফিয়ার বাঙালিদের মুখে মুখে। উইকএন্ডের অন্য প্রোগ্রাম বাতিল করে শনিবার কিঙ্গ অফ প্রাশিয়ায় কারও বাড়ি তো রবিবার সেন্টার সিটিতে কারও বাড়িতে মহড়া বসছে। অনুত্তমার স্বামী শিঙাড়া, আর চা এগিয়ে দিচ্ছেন হাতেহাতে। হঠাৎ গিয়ে পড়লে মনে হবে বুঝি ঝকঝকে আরও এক কলকাতা।
পুজোটা হাঁটি হাঁটি পায়েই চলতে শুরু করেছে বলা যায়। তবু এ বার পুজোয় ফিলাডেলফিয়ার প্রবাসী বাঙালিদের অনেকেরই গন্তব্য ‘ঘরোয়া’। ফিলাডেলফিয়ায় গত চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রগতি’র পুজোই ছিল একমাত্র। বছর তিনেক হল পুজোর সংখ্যা দুটি। বাঙালির নাটকের দল থেকে একান্নবর্তী পরিবার সবই ভাঙে । শুধু ভাঙে না মন। নতুন উদ্যমে তার সংস্কৃতিসৃজন চলে। ফরাসডাঙা আর ফিলাডেলফিয়ায় সেখানে তফাত নেই।
এ বার ঘরোয়া’র পুজো হবে আপার মেরিয়ন হাই স্কুলে। ২৩ আর ২৪ সেপ্টেম্বর এই দু’দিন। উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ পুজো কমিটি এই দু’টো দিনকেই বেছে নিয়েছে। চারদিনের পুজো দু’দিনে সারতে হবে ঠিকই। তবে ষষ্ঠী থেকে দশমী—যে প্রধান লক্ষণ দিয়ে পুজো চেনা যায়, বোধন, সন্ধিপুজো, কুমারীপুজো, সে সব কিছুই থাকবে। বাদ থাকবে না ধুনুচি নাচ থেকে সিঁদুর খেলা।
খাওয়াদাওয়াতেও বাঙালিয়ানা ষোলো আনা। প্রথমদিন পাঁঠার মাংস। পরের দিন চিংড়ি মাছের মালাইকারি, চিলি চিকেন। এ ছাড়া খিচুড়ি ভোগের ব্যবস্থাও রয়েছে। গতবার শ’চারেক মানুষ এসেছিলেন। এ বার সংখ্যাটা আরও বাড়বে, আশা উদ্যোক্তাদের।
প্রথমদিন অনীক-অদ্রিজা’র অনুষ্ঠান। পরেরদিন নিজেরাই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন প্রবাসীরা। রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’ অণুপ্রাণিত ‘ভুল স্বর্গ’ অভিনীত হবে। তার প্রস্তুতি পুরোদমে। কচিকাঁচারাও পিছিয়ে নেই। ওরা করবে ‘দুর্গাস্তুতি’।
শুধু দুর্গাপুজো নয়। লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো হবে। তারও প্রস্তুতি রয়েছে। আর প্রতি বছর দেশে এবং প্রবাসে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজেও ঘরোয়া যথাসাধ্য সহায়তা করে থাকে। আনন্দ ভাগ করে নেওয়াই একমাত্র লক্ষ্য।
নিজের মাটি থেকে বহু দূরে নিজেদের সংস্কৃতিতে মোড়া এক টুকরো নিজস্বতায় প্রাণ ভরে দু’দিন শ্বাস নেওয়ার প্রতীক্ষায় রয়েছেন ফিলাডেলফিয়ার প্রবাসীরা।
ছবি: সুদীপ্ত দোলুই।