শ্রীলঙ্কা বিস্ফোরণ কাণ্ড: গোয়েন্দা-ব্যর্থতাতেই কি নিহত ২৯০

শ্রীলঙ্কার পুলিশপ্রধান পুজুত জয়সুন্দর দিন দশেক আগেই এই ধরনের হামলা নিয়ে সতর্ক করেছিলেন বলে গত কাল জানা গিয়েছিল। হামলার আশঙ্কায় পুলিশপ্রধান যে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিলেন, তাতে বলা হয়েছিল, ‘ন্যাশনাল তৌহিত জামাত’ (এনটিজে) দেশের বিভিন্ন গির্জায় আত্মঘাতী হামলার ছক কষছে।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

কলম্বো শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:১৬
Share:

বিদায়: জঙ্গি হানায় নিহত নাতনির শেষকৃত্যে আহত বৃদ্ধা। ছবি: রয়টার্স।

আট-আটটি বিস্ফোরণের ধাক্কায় শ্রীলঙ্কায় নিহতের সংখ্যা সোমবার পৌঁছল ২৯০-এ। আহত অন্তত ৫০০ জন এখনও কলম্বো-সহ দেশের একাধিক হাসপাতালে লড়াই চালাচ্ছেন। তার মধ্যেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে একের পর এক বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

Advertisement

কলম্বোর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাসস্ট্যান্ড থেকে আজই শ্রীলঙ্কা পুলিশ ৮৭টি ডিটোনেটর উদ্ধার করেছে। কলম্বো বিমানবন্দরের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিস্ফোরক ভরা ছ’ফুট লম্বা একটি প্লাস্টিকের পাইপ। সেটিকে দ্রুত নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। একটি গির্জার সামনে পড়ে থাকা ভ্যানে বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করার সময় আরও একটি বিস্ফোরণ হয়। তবে এই ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি বলে সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে।

এ দিন সব মিলিয়ে পুলিশ ২৪ জন সন্দেহভাজনকে হেফাজতে নিয়েছে। সোমবার মাঝরাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত দেশ জুড়ে শর্তাধীন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে প্রেসিডেন্টের দফতর সূত্রে। মঙ্গলবার জাতীয় শোকদিবস। শ্রীলঙ্কার জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল জানিয়েছে, সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে মাঝরাত থেকে জরুরি অবস্থা জারি করা হচ্ছে, ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করার কোনও উদ্দেশ্য তাদের নেই।

Advertisement

দেশ জুড়ে দশকের ভয়াবহতম জঙ্গি হামলার পিছনে ‘ন্যাশনাল তৌহিত জামাত’ (এনটিজে) নামে একটি মৌলবাদী সংগঠনের দিকেই সোমবার আঙুল তুলেছে শ্রীলঙ্কা প্রশাসন। স্থানীয় এই গোষ্ঠীটির পিছনে আন্তর্জাতিক চক্রের হাত রয়েছে বলে দাবি প্রশাসনের। বিস্ফোরণের ছ’টি জায়গা অর্থাৎ তিনটি গির্জা— সেন্ট অ্যান্টনিস, সেন্ট সেবাস্টিয়ান ও জ়িওন চার্চ এবং তিনটি পাঁচ তারা হোটেল অর্থাৎ দ্য সিনামন গ্র্যান্ড, শাংগ্রি লা, ও দ্য কিংসবেরি থেকে পাওয়া দেহাংশের নমুনা পরীক্ষা করে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, সাত জন আত্মঘাতী বোমারু ওই ছ’টি জায়গায় হামলা চালিয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক জন হামলাকারী ছিল, তবে কলম্বোর পাঁচতারা হোটেল শাংগ্রি লা-য় ছিল দুই আত্মঘাতী বোমারু। বাকি দুই বিস্ফোরণের জায়গা নিয়ে এখনও তদন্ত চলছে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

শ্রীলঙ্কার পুলিশপ্রধান পুজুত জয়সুন্দর দিন দশেক আগেই এই ধরনের হামলা নিয়ে সতর্ক করেছিলেন বলে গত কাল জানা গিয়েছিল। হামলার আশঙ্কায় পুলিশপ্রধান যে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিলেন, তাতে বলা হয়েছিল, ‘ন্যাশনাল তৌহিত জামাত’ (এনটিজে) দেশের বিভিন্ন গির্জায় আত্মঘাতী হামলার ছক কষছে। এমনকি কলম্বোয় ভারতীয় দূতাবাসেও হামলা হতে পারে।’ এই তথ্য হাতে আসা সত্ত্বেও প্রশাসনের তরফে কোনও ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয়নি, এখন উঠছে সেই প্রশ্ন। গোয়েন্দা স্তরে এত বড় মাপের ব্যর্থতার মাসুল দিল ২৯০টি প্রাণ। কিন্তু সরকারের শীর্ষ স্তরের অফিসারদের দাবি, এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাঁদের হাতে এসে পৌঁছয়ইনি!

রবিবার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহেও জানিয়েছিলেন, আগাম সতর্কবার্তা সম্পর্কে তাঁকে বা তাঁর মন্ত্রকের কাউকেই কিছু জানানো হয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘কেন কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি, আমরা অবশ্যই খতিয়ে দেখব।’’

কূটনীতিকরা যদিও এর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বই দেখতে পাচ্ছেন। দেশের প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা সিরিসেনা, যিনি একই সঙ্গে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীও বটে, তাঁর সঙ্গে বিক্রমসিংহের টানাপড়েন তৈরি হয়েছে গত বছর ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় থেকেই। রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হওয়ার পরে গত বছর অক্টোবরে সিরিসেনা তাঁর ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন প্রেসিডন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছিলেন। কিন্তু পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া সিরিসেনা-রাজাপক্ষে জুটির কাছে বড় ধাক্কা ছিল। সিরিসেনা গত বছর নভেম্বরে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও শ্রীলঙ্কার সুপ্রিম কোর্ট তা অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। এর পরে আইনি পথে বিক্রমসিংহেকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানো হয়। আগামী বছর দেশে সাধারণ নির্বাচন। এই বিস্ফোরণের জেরে সরকারের অন্দরে রাজনৈতিক সঙ্কট ফের প্রকট হল বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকারি স্তরে বিস্ফোরণের সতর্কবার্তা না পৌঁছনো নিয়ে এখন তাই পাল্টা দোষারোপের পালা চলছে। সোমবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী রজিত সেনারত্নে জানিয়েছেন, দশ দিন আগে থেকে নয়, গত ৪ এপ্রিল থেকেই সতর্কবার্তা ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর সঙ্গীরা পরিস্থিতি সম্পর্কে ‘এতটুকুও ওয়াকিবহাল ছিলেন না’। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দাবি, সরকারের মধ্যেই সমন্বয়ের চূড়ান্ত অভাব রয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে একটি বৈঠক ডাকার চেষ্টা করেছিলেন। মন্ত্রিসভার সদস্যরাই সেই বৈঠকে আসবেন না বলে জানিয়ে দেন। এ দিকে, ৪ এপ্রিল সতর্কবার্তা আসা সত্ত্বেও তা দেরিতে কেন জানানো হল, আপাতত সেই অভিযোগে পুলিশপ্রধান পুজুত জয়সুন্দরের ইস্তফা দাবি করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

আন্তর্জাতিক একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানাচ্ছে, শ্রীলঙ্কার পুলিশপ্রধানের পাঠানো সতর্কবার্তায় শুধু এনটিজে-র নামই ছিল না, কয়েক জন সদস্যের নামও ছিল। মার্কিন বিদেশ দফতর সূত্রে আজ জানানো হয়েছে, শ্রীলঙ্কায় আরও হামলার ষড়যন্ত্র চলছে। পর্যটকদের জনপ্রিয় গন্তব্য, পরিবহণ কেন্দ্র, বাজার, শপিং মল, সরকারি দফতর, হোটেল এবং ধর্মীয় স্থানে ফের হামলার সম্ভাবনা রয়েছে বলে দাবি। রবিবারের হামলায় চার মার্কিন নাগরিক নিহত হয়েছেন বলেও জানিয়েছে আমেরিকা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement