আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক সমীকরণের কথা মাথায় রেখে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে তিক্ততা চাইছে না চিন। তাই লাদাখে আন্তর্জাতিক সীমান্ত লঙ্ঘন করে আর উত্তেজনা তৈরি করেছে না চিনের পিপল’স লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)। গত কয়েক বছরে বার বার সীমা পেরিয়ে লাদাখে ঢুকে পড়েছে চিনের সেনা। কিন্তু সেপ্টেম্বরে ভারত পাল্টা প্রত্যাঘাত করার পরই বদলে গিয়েছে ছবিটা। ভারতীয় বাহিনীর হামলায় বিতর্কিত এলাকায় নির্মীয়মান চিনা ওয়াচ টাওয়ার গুঁড়িয়ে যেতে সাময়িক উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তার পর থেকে লাদাখ শান্তই। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতির সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই চিন এখন সংযমী।
ঠিক কী হয়েছিল লাদাখে?
লাদাখ এলাকায় ভারত চিন সীমান্ত স্পষ্ট নয়। জম্মু-কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চল আর চিনের দখলে থাকা তিব্বতের মধ্যে বিভাজন রেখা হল ‘লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ বা এলএসি। বেশ কিছু এলাকায় এলএসি-র অবস্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তাই ভারত-চিন দু’পক্ষই নিজের নিজের এলাকায় একটি ‘বর্ডার পেট্রোলিং লাইন’ বা ‘সীমান্ত টহলদারি রেখা’ মেনে চলে। দু’দেশের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতেই এই এলএসি নির্দিষ্ট হয়েছে। বিতর্কিত এলাকায় না ঢুকে ওই বর্ডার পেট্রোলিং লাইন বরাবরই টহল দেয় চিনের পিএলএ এবং ভারতের ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ (আইটিবিপি)। গত কয়েক বছরে চিনের তরফে সেই বর্ডার পেট্রোলিং লাইন লঙ্ঘন করার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। প্রতি বারই ভারত তীব্র আপত্তি জানিয়েছে চিনা সেনার এই আচরণে। সীমান্তে দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে ফ্ল্যাগ মিটিং করে সমস্যার সমাধান খোঁজা হয়েছে। কিন্তু ফ্ল্যাগ মিটিং হওয়ার আগে পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান থেকে কিছুতেই পিছু হঠতে রাজি হয়নি চিনা বাহিনী।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি উত্তেজনার শিখরে পৌঁছয়। চিন বিতর্কিত এলাকায় ঢুকে একটি ওয়াচ টাওয়ার বানানো শুরু করেছিল। ভারতীয় বাহিনী একধিক বার তা নিয়ে আপত্তি জানায়। তবু বিতর্কিত এলাকায় ওয়াচ টাওয়ার বানানো বন্ধ করেনি চিন। এ বার আর ফ্ল্যাগ মিটিং-এর রাস্তায় হাঁটেনি ভারত। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক প্রত্যাঘাতের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই মতো আইটিবিপি সরাসরি হামলা চালায় নির্মীয়মান ওয়াচ টাওয়ারে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের আঘাতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় চিনের ওয়াচ টাওয়ার।
ভারতের এই পদক্ষেপে প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি হয় সীমান্তে। চিন বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে দেয় সীমান্তে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ভারতও লাদাখ সীমান্তে বিপুল সৈন্য সমাবেশ করে। পরে ধীরে ধীরে উত্তেজনা প্রশমিত হয়। কিন্তু ভারতের জন্য সুখবর, আইটিবিপি প্রত্যাঘাত করে চিনা টাওয়ার গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর থেকে গত তিন মাসে আর এক বারও লাদাখে সীমান্ত লঙ্ঘন করেনি পিএলএ। চিনা বাহিনী এখন টহলদারি চালাচ্ছে বর্ডার পেট্রোলিং লাইন মেনেই। কারণ চিন বুঝেছে, সীমান্ত লঙ্ঘন করলে উত্তেজনা বাড়বে। তাতে কম-বেশি দু’পক্ষেরই ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সংক্রান্ত আরও খবর...
ভারত-জাপান মিত্রতায় অশনি সঙ্কেত দেখছে চিন
ভারত যেমন চিনের সঙ্গে সহজে সঙ্ঘাতে যেতে চায় না, তেমন চিনও এখন চাইছে না ভারতের মতো শক্তিশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে শত্রুতা বাড়াতে। দক্ষিণ চিন সাগরের দখল নিয়ে আমেরিকা-চিন দ্বৈরথ তার অন্যতম প্রধান কারণ। চিনের সঙ্গে জলসীমা নিয়ে বিবাদ রয়েছে জাপান, ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্সের। ফিলিপিন্সের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে আমেরিকা। ফলে জলসীমার দখল নিয়ে শুরু হওয়া বিবাদে চিন-আমেরিকা এখন কার্যত যুযুধান অবস্থানে। প্রতিবেশীদের মধ্যে বেশিরভাগই আমেরিকার দিকে ঝুঁকে রয়েছে। ভিয়েতনাম আমেরিকার শিবিরে নাম না লেখালেও, চিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই। বরং ভারতের উপরই বেশি নির্ভরশীল ভিয়েতনাম। জাপান-ভারত মৈত্রীও চিনের মাথাব্যাথার অন্যতম কারণ। বেজিং বুঝেছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে তিক্ততা বাড়লে, দক্ষিণ চিন সাগরের লড়াইতে আরও ভারী হবে আমেরিকার পাল্লা। আর ঘরের পাশে এত শক্তিশালী প্রতিবেশীকে শত্রু বানিয়ে রেখে আমেরিকার সঙ্গে টক্কর নেওয়াও বেশ ঝুঁকির কাজ হবে। তাই লাদাখ এবং অরুণাচল প্রদেশে উত্তেজনা আর বাড়াতে চাইছে না বেজিং।
চিনের তরফে উত্তেজনা প্রশমনের এই প্রচ্ছন্ন বার্তাকে ভারতও গুরুত্ব দিয়েই দেখছে। লাদাখে শান্তি বজায় রাখার জন্য ভারতের তরফেও তৎপরতা যথেষ্ট। সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর থেকে চিনের মতো ভারতের বাহিনীও অনেক সতর্ক হয়ে কাজ করছে লাদাখ সীমান্তে। দু’দেশের বাহিনীর মধ্যে ফ্ল্যাগ মিটিং-এর সংখ্যা বাড়ানোর উপর জোর দেওয়া হয়েছে। কূটনৈতিক পর্যায়েও কথাবার্তা হয়েছে। ফলে লাদাখে গত তিন মাসে সীমা লঙ্ঘন করার অভিযোগ এক বারও ওঠেনি পিএলএ’র বিরুদ্ধে। অরুণাচল প্রদেশকেও সাম্প্রতিক কালে নিজেদের এলাকা তথা দক্ষিণ তিব্বত বলে দাবি করেনি চিন। তাই এখন এক দিকে চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়িয়ে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি তরান্বিত করার কথা ভাবছে ভারত সরকার। অন্য দিকে ভারতের বাজারে ব্যবসা করা এবং বেজিং-এর বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের সঙ্গে নয়াদিল্লির হাত মেলানো রুখতে, ভারতকে বৈরীতা হ্রাসের বার্তা দিতে তৎপর চিনও।