হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল বাংলাদেশ। ছবি: রয়টার্স।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ৪ অগস্ট, রবিবার থেকে বাংলাদেশ জুড়ে শুরু হয়েছে সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি। আন্দোলনের নয় দফা দাবি এখন নেমে এসেছে এক দফায়— হাসিনা সরকারের পদত্যাগ। এর মধ্যেই রবিবার ‘অন্তর্বর্তিকালীন গণতান্ত্রিক সরকার’ গঠনের ডাক দিল গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’ জানাচ্ছে, সাতটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন নিয়ে গঠিত এই ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট’। রবিবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি যৌথ বিবৃতিতে জোটের সদস্যেরা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, এই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তিকালীন গণতান্ত্রিক সরকার গড়তে হবে দেশের আপামর শ্রেণি-পেশার মানুষকে। বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর রয়েছে জোটের সমন্বয়ক ও ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি রাগীব নাঈম, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) সভাপতি সালমান সিদ্দিকী, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি দিলীপ রায়, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি ছায়েদুল হক, ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মিতু সরকার, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অঙ্কন চাকমা এবং বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের সভাপতি তাওফিকা মিয়ার।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কোটা সংস্কারের দাবিকে ঘিরে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন দমন করতে বর্বরোচিত ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’ ঘটিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। পুলিশ, বিজিবি এবং র্যাবের সম্মিলিত বাহিনী হত্যা করেছে অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে। এই সরকারের হাতে ছাত্র-জনতার রক্ত লেগে রয়েছে। তাই গোটা দেশের জনগণের এখন সম্মিলিত এক দফা, এক দাবি— অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে এই সরকারকে। এর পরেই বিবৃতিতে ‘অন্তর্বর্তিকালীন গণতান্ত্রিক সরকার’ গঠনের ডাক দিয়েছেন তাঁরা। এই সরকারের প্রাথমিক কাজগুলি হবে আন্দোলনকারীদের নামে দায়ের হওয়া সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করা, আটক সকলকে মুক্তি দেওয়া, গণহত্যা ও নির্যাতনের তদন্ত ও বিচার, ছাত্র-জনতা হত্যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবিলম্বে খুলে দেওয়া এবং সর্বোপরি, ‘জুলাই হত্যাকাণ্ডে’ গুম-খুন, নিখোঁজ ও মৃতদের নামের তালিকা এবং প্রকৃত হিসাব প্রকাশ্যে আনা।
প্রসঙ্গত, ‘জুলাই হত্যাকাণ্ডে’র স্মরণে ৩১ জুলাইয়ের পর থেকে ৩২, ৩৩, ৩৪ করে দিন গুনছে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা। অর্থাৎ হিসাব মতো ৫ অগস্ট, ‘৩৬ জুলাই’ ঢাকা গণভবনের দিকে ‘লং মার্চ’-এর ডাক দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বিগত কয়েক সপ্তাহে পুলিশ-প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের যৌথ হামলায় অগণিত ছাত্র-জনতার মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। আন্দোলনকারীদের যৌথমঞ্চ, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ডাকে রবিবার থেকে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন।
প্রসঙ্গত, জনরোষের মুখে পড়ে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট কোটা সংস্কারের পক্ষে রায় দিলেও ন’দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। ধৃত আন্দোলনকারীদের মুক্তি, সমস্ত মামলা প্রত্যাহার, কোটা আন্দোলনে হামলাকারীদের শাস্তি-সহ আরও বিভিন্ন দাবি ছিল আন্দোলনকারী ছাত্রদের। কিন্তু বিগত কয়েক সপ্তাহে পুলিশ-প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের যৌথ হামলায় একের পর এক মৃত্যুর পর এখন নয় দফা দাবির পরিবর্তে একটি মাত্র দাবি নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন— হাসিনা সরকারের পদত্যাগ। অন্যথায় সর্বাত্মক অসহযোগের ডাক দিয়েছে তারা। বলা হয়েছে, অসহযোগ চলাকালীন বাংলাদেশের কোনও নাগরিক আর কর দেবেন না। দেবেন না বিদ্যুৎ, গ্যাস বা অন্যান্য পরিষেবা বাবদ বিলও। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে সরকারি-বেসরকারি সমস্ত প্রতিষ্ঠান— স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত। কেবলমাত্র হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, অ্যাম্বুল্যান্স, দমকল, ইন্টারনেট পরিষেবা দফতর, সংবাদমাধ্যমের মতো জরুরি পরিষেবাগুলি চালু থাকবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানগুলি খোলা রাখা হবে সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত।
রবিবার সকাল থেকেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি ছিল ঢাকা-সহ গোটা দেশ জুড়ে। রবিবার সারা দিনে আন্দোলনকারী এবং আওয়ামী লীগ ও বাহিনীর সংঘর্ষে দেশে ১৪ পুলিশ-সহ ১০১ জন নিহত হয়েছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে রবিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে ঢাকা-সহ সব শহরে কার্ফু জারি করেছে শেখ হাসিনা সরকার। বন্ধ রাখা হয়েছে মোবাইল ইন্টারনেট, ফোর জি পরিষেবা, সমাজমাধ্যম। ঘোষণা করা হয়েছে তিন দিনের ছুটি। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা যায়নি। উল্টে আন্দোলনকারী মঞ্চ ‘ঢাকা চলো’ (মার্চ টু ঢাকা) কমর্সূচির দিন এগিয়ে এনেছে। ৬ অগস্টের পরিবর্তে ৫ অগস্ট, সোমবার ওই কর্মসূচি পালন করা হবে, জানান আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। দেশবাসীকে কার্ফু মেনে চলতে অনুরোধ করেছে সেনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য, যাঁরা নাশকতা করছেন, তাঁরা ছাত্র নন, জঙ্গি। তাঁদের দমন করতে দেশবাসীর সাহায্য চেয়েছেন তিনি। বারণ সত্ত্বেও আজ, সোমবার ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকায় কার্ফু ভেঙে জড়ো হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে মোতায়েন করা হয়েছে সেনা। এই প্রতিবেদন প্রকাশের কিছু ক্ষণ আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবাও।