চট্টগ্রামে কর্ণফুলি সুড়ঙ্গপথ। নিজস্ব চিত্র।
এমনিতেই পদ্মার এক পারে দাঁড়িয়ে অন্য পারের হদিস মেলে না। তার উপরে শীতের এই দিনটি ঘিরে ঘন কুয়াশার চাদর। চোখের সামনে সদ্য খুলে যাওয়া পদ্মা সেতু। ভরদুপুরেও সেই সেতুর অন্য প্রান্তটি যেন অনায়াসে হারিয়ে গিয়েছে আবছায়ায়। শুধু নির্নিমেষ পদ্মাকেই বাঁধেনি নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই সেতু, এক ধাক্কায় গড়িয়ে দিয়েছে গোটা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে। গর্বের সেতু যেন মাথা তুলে বলছে— আমরা পেরেছি!
আবার বহতা কর্ণফুলির এক পারে বন্দর, বিমানবন্দর, তেলের ভান্ডার, অন্য পারে চট্টলা নগরী। আছে বটে নতুন-পুরনো মিলে তিনটি সেতু, প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আরও সেতু বানালে নাব্যতার সঙ্কট বাড়বে, বন্দরে বড় জাহাজের আনাগোনায় ভাটা পড়বে। তাই এ বার আর সেতু নয়, কর্ণফুলির নীচে দিয়ে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। তৈরির কাজ শেষ হয়ে উদ্বোধনের অপেক্ষা। আবার চট্টগ্রাম নগরীকে নীচে ফেলে আগাগোড়া সেতুতে চড়ে তৈরি হচ্ছে ‘এলিভেটেড হাইওয়ে’। বন্দর থেকে পণ্য ও কন্টেনার নিয়ে শহরকে এড়িয়ে এই পথে সাঁই সাঁই ছুটে যাবে হাজার হাজার ট্রাক।
নদীমাতৃক দক্ষিণের উর্বর ভূমি শস্যশ্যামলা। এত দিন সেখানে ছিল অতিফলনের জেরে ফসল নষ্টের হাহাকার, আবার উত্তরের সুবিস্তীর্ণ এলাকায় একফসলি জমির কারণে উৎপাদনহীনতা, কর্মহীনতা থেকে ‘মহেঙ্গা’ বা মঙ্গা পরিস্থিতি। নিত্যপণ্যও এই সময়ে সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। ফি বছর শরৎ আসে, বাংলাদেশের অনেকটা অঞ্চলে আসে মঙ্গার হিমশীতল ত্রাস। দক্ষিণের ফসল পদ্মা ডিঙিয়ে উত্তরে পৌঁছনো ছিল দুঃসাধ্য। এমন কুয়াশা দিনে ফেরি অচল। ট্রাকের সারি আটকে থাকত মাওয়া বা গোয়ালন্দ-রাজবাড়িতে। উত্তরের বাজার এখন দক্ষিণের শস্যগোলার দৃষ্টিসীমায়, সৌজন্য পদ্মা সেতু। আবার সাড়ে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ৪১টি স্প্যানের পদ্মা সেতুর আড়ালে পড়ে গিয়েছে দক্ষিণ বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীতে নির্মিত ৩৫টি ছোটবড় সেতু, যা প্রত্যন্ত এলাকাকেও টেনে এনেছে নগর সভ্যতার পাশে।
সত্যিই বদলে গিয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকায় নেমে বিমানবন্দরের বাইরে দু’কদম এগোতেই ঝাঁ চকচকে মেট্রোরেলের সঙ্গে দেখা। দিনের সূর্য উঁকি মারে একের পর এক গগনবিহারী উড়ালপুলের লুপ-এর ফাঁক দিয়ে। আপাতত কয়েকটি স্টেশনে দৌড়চ্ছে মেট্রো, তবে উড়ালপুল প্রায় সবই চালু হয়ে গিয়েছে। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলছিলেন, “বদলটা আর কথার কথা নয়। জনজীবনকে অনায়াসে স্পর্শ করছে এই বদল। উন্নয়নের গতিটা আরও বাড়বে আরও কয়েকটা বছর পরে, যখন সমস্ত পরিকাঠামো প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে যাবে। এখনই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারে এশিয়ার সব দেশকে ছাপিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। এ বার লক্ষ্য আরও অগ্রগতি।”
পরিকাঠামো বাড়লে ঘরোয়া উৎপাদন বাড়বে, বাড়বে মাথাপিছু আয়ও। ২০০৬-এ বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ ডলার। ২০২২-এ সরকারি দাবি অনুসারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮২৪ ডলারে। এক অফিসারের কথায়, ঢাকার বহু রিকশাচালক এখন মাসে এক বার হলেও শখ করে এক জোড়া চাঁদপুরের ইলিশ কিনে ঘরে ঢোকেন। মাসের শেষে পোশাকশ্রমিক নারীদের লাইন পড়ে চাহিদার কারণে গজিয়ে ওঠা ইতিউতি ‘বিউটি পার্লার’-এ।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর স্লোগান বদলে ভোটের এক মাস আগে শেখ হাসিনা তাই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর কথা বলছেন। তাঁর কথায়, সরকারের উদ্যোগে ডিজিটাল সুযোগ পৌঁছে গিয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামের ঘরে ঘরে। বাংলাদেশ আরও ‘স্মার্ট’ হবে, বাংলাদেশের নাগরিকদেরও পৃথিবীর উন্নত দেশের নাগরিকদের মতো হতে হবে ‘স্মার্ট’।