— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
এ বারের পুজো অন্য বারের থেকে অনেকটা আলাদা। পুজো বলতে বাংলার যে রূপকথার ছবি ফুটে ওঠে, এ বারে তাতে পড়েছে বাস্তবের একটা হিংস্র আঁচড়। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, হাঁসুলীবাঁকের ভাঁজে কাশফুল, রাজপথের ধার ঘেঁষা শিশির-ভেজা মাঠ ডিঙিয়ে অচিনপুরের গ্রাম— এ সবের মাঝে এক বিষাদের সুর। দেশের মতোই, সাতসমুদ্র পারে, যখন সবে পুজোর ঢাকে কাঠি পড়েছে ব্যাভারিয়ার ছোট্ট মফঃস্বল শহর এরল্যাঙ্গেনে, তখনই শহর তিলোত্তমার বুকে, মধ্যরাত্রের বিভীষিকায় মুছে গেল সবার সব উচ্ছ্বাস। মৃন্ময়ী দেবীর আবাহনের আগেই, রক্ত-মাংসের দেবীর বিসর্জনের সাক্ষী থাকল গোটা দেশ।
কলকাতার বুকের এক গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে জঘন্য বর্বরতার শিকার হয়ে খুন হলেন এক ডাক্তার। ঘটনার নারকীয়তায় নড়ে বসল সারা দেশই, নারী স্বাধীনতা পড়ল একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মুখে। আর বরাবরের মতোই তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে প্রতিবাদে ফেটে পড়ল শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে সারা রাজ্য। মহানবমীর রাতের মতো, রাস্তার দখল নিলেন মানুষ, মশাল হাতে। ঠিক তখন, শহর থেকে, দেশ থেকে সাত হাজার কিলোমিটার দূরে,আমরা, যারা এই জমি বুঝে নেওয়ার রাস্তায় নামতে পারলাম না, অসহায়ত্ব–ভয়–বিষাদ-একাকীত্ব— একটু একটু করে ঘিরে ফেলল সবাইকে। উৎসবের থেকেও এই প্রতিবাদে বাড়ির কাছের মানুষগুলোর সঙ্গে না থাকতে পারার অনুশোচনা হল অনেক বেশি।
সেই বিহ্বলতার মধ্যে, আমরা সবাই আঁকড়ে ধরলাম শারদীয়াকেই। সব বিভেদ ভুলে, সবাই একসঙ্গে আসা, মানুষে-মানুষে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে ভয়-বিষাদ ঠেলে সরিয়ে দেওয়াই বোধহয় শারদোৎসব, সব উৎসবের চেয়ে অনন্য। মায়ের কাছে অঞ্জলি দিয়ে দৈনন্দিন কাজের মধ্যে আবার জড়ো করা প্রতিবাদের শক্তি। এ বার আমাদের পুজোয় তাই ষষ্ঠীর বোধন, সপ্তমীর নবপত্রিকা স্নান, সন্ধিপুজোর একশো আট পদ্মে মায়ের আরাধনা সবই থাকছে, খালি থাকছে না উৎসবের আড়ম্বর।
পঞ্জিকা মেনে ষষ্ঠী থেকে দশমী পূজিত হবেন আমাদের মনোময়ী একচালা প্রতিমা, যা গত বছর স্থানীয় বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার দীপঙ্কর সরকার জার্মানির মাটিতেই একেবারে কাঠামোয় খড় বেঁধে তৈরি করেছিলেন। প্রতিমা প্রস্তুত থাকায়, এ বার আমাদের প্রধান নজর ছিল মণ্ডপ সজ্জায়। গ্রাম বাংলার সৌম্য আর সাবেকিয়ানাকে এক মলাটে ধরার জন্য এ বার আমাদের পুজোর মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে একটি রাজবাড়ির আদলে। বাংলা মায়ের নকশি কাঁথার আলপনা থেকে ইটরঙা রাজবাড়ির নাটমঞ্চ, সুদূর এই জার্মানির মাটিতে তুলে আনাই ছিল আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। রথের দিন নিজেদের হাতেই কাঠ কেটে পাটাতন বানানোর কাজ শুরু হল। এরল্যাঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একঝাঁক বাঙালি ছাত্র কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে কার্ডবোর্ডের দেওয়ালে তুলল লালের পরত, হাত লাগালেন অনেক প্রবাসী ভারতীয়েরাও।
এ বার পুজোয় আমাদের উপরি পাওনা— এরল্যাঙ্গেন শহরের পৌরসভার বিশেষ সাহায্য। ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে জার্মানির মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য এ বছর তারা একটি প্রয়াস করছে, তার সঙ্গী হয়েছি আমরাও। সেই জন্য, আমাদের মণ্ডপের নানা অংশে নানা পোস্টারে আমরা মেলে ধরছি ভারতের খাদ্য-বস্ত্র-শিল্পকলা থেকে স্থাপত্যের সম্ভার।
তবে পুজোর রোশনাইয়েও অটুট থাকছে আমাদের প্রতিবাদ। মণ্ডপের সামনেই থাকছে সংহতি মঞ্চ। দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে, প্রদীপের আলোয় স্মরণ করবেন নিহত চিকিৎসককে। মায়ের আশিস নিয়ে আমরা অঙ্গীকার করব শহর কলকাতার পাশে থাকার, উৎসবে ও প্রতিবাদে।