—প্রতীকী চিত্র।
পার্কিনসন্স ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে বিশ্বে এক কোটির বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। অথচ ১৮১৭ সালে চিকিৎসক জেমস পার্কিনসন্স চিহ্নিত এই রোগ সম্পর্কে দু’দশক আগেও মানুষের ধারণা তেমন ছিল না। বর্তমানে শুধু প্রবীণ নয়, কমবয়সি পার্কিনসন্স আক্রান্তের সংখ্যাও চিন্তার কারণ। ক্যানসারের মতোই বেড়ে চলেছে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। যদিও এর গবেষণা চলেছে নিরন্তর। যার স্বীকৃতি মিলল আন্তর্জাতিক স্তরে। স্বীকৃতি পেয়েছে ক্যানসার থেরাপির গবেষণাও।
২০২৪ সালের ব্রেকথ্রু প্রাইজ় ফাউন্ডেশন মূলত পার্কিনসন্স ডিজ়িজ়, কার টি সেল (সিএআর টি, এটি মলিকিউলার জেনেটিক কোডিং) ক্যানসার থেরাপি এবং সিস্টিক ফাইব্রোসিসের গবেষণাকে সম্মান জানাতে আট জন বিজ্ঞানীর নাম ঘোষণা করেছে। বিজ্ঞান ক্ষেত্রে অস্কার মানা হয় এই পুরস্কারকে। আগামী বছরের ১৩ এপ্রিল আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে দেওয়া হবে পুরস্কার।
পার্কিনসন্স রোগের ঝুঁকিবাহক জিনকে তাঁদের গবেষণায় চিহ্নিত করে পুরস্কৃত হলেন ইউনিভার্সিটি অব টুবিংএনের স্নায়ুবিজ্ঞানী টমাস গ্যাসার, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন এজিংয়ের নিউরোজেনেটিসিস্ট অ্যান্ড্রু সিঙ্গলটন এবং ন্যাশনাল হিউম্যান জিনোম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জেনেটিসিস্ট অ্যালেন সিনড্রেনস্কি। পুরস্কার পাচ্ছেন ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার ইমিউনোলজিস্ট কার্ল জুন, মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যানসার সেন্টারের ইমিউনোলজিস্ট মিশেল স্যাডেলেন। কার্ল এবং মিশেল পুরস্কার পেলেন কার টি সেল ইমিউনোথেরাপির আরও উন্নয়নের গবেষণায়। সিস্টিক ফাইব্রোসিসের চিকিৎসায় সংমিশ্রিত ওষুধ আবিষ্কার করে পুরস্কৃত হলেন ভার্টেক্স ফার্মাসিউটিক্যালসের গবেষক সাবিন হাদিদা, পল নেগুলেস্কু এবং ফ্রেডরিক ভন গুর।
পার্কিনসন্স রোগের ঝুঁকিবাহক জিনকে চিহ্নিত করার গবেষণা শুরু হয়েছিল অন্য ভাবে। শিশুরোগ চিকিৎসক অ্যালেন সিনড্রেনস্কি তখন জিনগত বিরল রোগ গোশের নিয়ে গবেষণায় বুঁদ। একটি মাত্র জিন, জিবিএ ওয়ানের গোলমাল কী ভাবে যকৃৎ, প্লীহা এবং অস্থির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে থাবা বসাতে পারে, সেটাই আকর্ষণ করেছিল সিনড্রেনস্কিকে। এমন পরিস্থিতিতে সিনড্রেনস্কির কাছে ফোন আসে সহকর্মীর। যিনি এমন এক রোগীর মস্তিষ্ক থেকে টিসু সংগ্রহ করেছিলেন, যাঁর গসার এবং পার্কিনসন্স দু’টিই আছে। মোট তিনটি নমুনা তিনি পাঠান সিনড্রেনস্কিকে। গাড়ির ঝাঁকুনিতে নমুনার লেবেল পড়ে যায়। ফলে কোনটা কোন নমুনা নিশ্চিত হতে সিনড্রেনস্কি এনজাইমের কাজ মাপার সিদ্ধান্ত নেন।
পরে ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা যায়, একটি নমুনায় মিউটেড জিবিএ ওয়ান জিনের দু’টি অনুলিপি ছিল। কিন্তু বাকি দু’টি নমুনায় মিউটেড জিবিএ ওয়ান জিনের একটাই অনুলিপি। যা দেখে ৫০ জনেরও বেশি পার্কিনসন্স রোগীর পোস্টমর্টেমে মস্তিষ্কের নমুনা থেকে ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখেন, ১২ জন জিবিএ ওয়ান মিউটেশন বহন করছেন। ওই সময়েই, অর্থাৎ, ২০০২ সালে টমাস গ্যাসার এবং অ্যান্ড্রু সিঙ্গলটন খুঁজছিলেন পার্কিনসন্স রোগের জিনগত সূত্র। যা মিলিত ভাবে গবেষণার দরজা খুলে দেয়।
সিনড্রেনস্কি বলছিলেন, ‘‘কেন বিরল রোগ নিয়ে গবেষণা করা হয়, তার এটি উদাহরণ। গবেষণার ফল বিরল রোগের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই সাধারণ জটিল রোগের ক্ষেত্রেও দৃষ্টান্তমূলক ফলাফল আনতে পারে।’’
দীর্ঘ বছর ধরে গবেষণাগারে টি কোষের ভূমিকায় শান দিয়ে তাকে আরও উন্নত করায় ব্যস্ত থেকেছেন জুন এবং স্যাডেলেন। টি কোষ হল রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার এক দক্ষ সৈনিক। টি সেল রিসেপ্টর (টিসিআর) ক্যানসারের কোষে অ্যান্টিজেন খুঁজে বার করে তাকে আটকে রাখে। সাম্প্রতিক কালে সেল থেরাপির এই চিকিৎসা নিয়ে চর্চা চলছে। যদিও গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে যখন স্যাডেলেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবে যোগ দেন, তখন সেল ইঞ্জিনিয়ারিং নতুন ক্ষেত্র। ক্যানসারের গবেষণায় টি কোষ নজর কেড়েছে বহু পরে। দীর্ঘ গবেষণার ফল দেখে ২০১৭ সালে প্রথম বার এফডিএ অনুমোদন দেয় কিছু ক্ষেত্রে শিশু এবং কমবয়সি লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকোমিয়ায় আক্রান্তদের সিএআর টি সেল থেরাপি করার।
অন্য দিকে, সিস্টিক ফাইব্রোসিসের জন্য দায়ী জিনকে ১৯৮৯ সালেই চিহ্নিত করা হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী দশকে বিজ্ঞানীরা মূলত প্রোটিন চিহ্নিত করেন এবং কী ভাবে ওই জিনের মিউটেশনে প্রোটিনের গঠনে ত্রুটি হচ্ছে, সেটাই তুলে ধরেন। কোষে ত্রুটিপূর্ণ প্রোটিন যথাযথ কাজ না করায় লবণ ও জলের ভারসাম্য নষ্ট হয়। ফলস্বরূপ আঠালো শ্লেষ্মা তৈরি হয়, যা প্যাথোজেনিক ব্যাক্টেরিয়া এবং ভাইরাসের আশ্রয়স্থল হয়। সিস্টিক ফাইব্রোসিস এমন রোগ, যা শরীরের যে কোনও অঙ্গে হতে পারে। তাই গবেষণা দল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মুখে নেওয়ার মতো কোনও ওষুধ আনতে হবে, যা সব অঙ্গকে প্রভাবিত করতে পারবে। সেই ত্রুটি সমাধানের পথ খুঁজতে বিজ্ঞানীদের পেরোতে হয়েছে ২০ বছর।