বোমায় উড়ে গিয়েছে সার দেওয়া মোটরবাইক। সোমবার ব্যাঙ্ককের রাচাপ্রাসং এলাকায়। ছবি: এএফপি।
ভাগ্যিস জরুরি বৈঠকে আটকে গিয়েছিলাম!
দিন কয়েক হলো, হাতঘড়িটা গোলমাল করছে। ভেবেছিলাম, আজ সন্ধেবেলায় রাচাপ্রাসং এলাকার কোনও শপিং মলে গিয়ে সেটা সারাবো। কিন্তু আটকে গেলাম একটা জরুরি বৈঠকে। আর তার পরেই কানে এল খবরটা।
শহরের অন্যতম জনবহুল এলাকা রাচাপ্রাসং চৌমাথা। সেখানকার ব্রহ্মা মন্দিরের সামনে আজ সন্ধে সাতটায় এক বিশাল বিস্ফোরণ হয়। শহরের ব্যস্ততম প্রাণকেন্দ্র মুহূর্তের মধ্যে বদলে যায় অন্য ব্যস্ততায়। পুলিশের গাড়ির আলোর ঝলকানি। ঘনঘন অ্যাম্বুল্যান্সের শব্দ আর প্যারামেডিকদের দৌড়োদৌড়ি। পুলিশ জানিয়েছে, রাস্তার পাশে দাঁড় করানো একটি মোটরবাইকে পাঁচ কিলো টিএনটি ছিল। সেটাই ফাটে। মুহূর্তে এ-দিক ও-দিক ছিটকে যায় আরও কয়েকটি মোটরবাইক, দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে পর পর দু’টো ট্যাক্সি। ছিটকে পড়েন মানুষজন, দুমড়ে যায় মন্দিরের সামনের মোটা মোটা লোহার গ্রিল। রাস্তার পাশে লাগানো সিসিটিভি ফুটেজে ভেসে উঠেছে সেই ছবি।
স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলো জানাচ্ছে, বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের। যদিও সরকারি সূত্রে নিহতের সংখ্যা ১৬। হাসপাতালগুলোর খবর, আহতের সংখ্যা কমপক্ষে ১১৭। নিহতদের মধ্যে চার জন বিদেশি রয়েছেন বলে জানিয়েছে ব্যাঙ্কক পুলিশ। তবে এখনও পর্যন্ত কোনও ভারতীয়ের হতাহতের খবর মেলেনি।
তবু ব্যাঙ্কক-বিস্ফোরণ কাঁপিয়ে দিয়েছে ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালিদের!
গত কয়েক বছর ধরে তাইল্যান্ড বাঙালিদের অত্যন্ত প্রিয় গন্তব্যস্থল। সস্তার বিমান টিকিট থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তসুলভ থাকা-খাওয়ার খরচের জন্য বিদেশভ্রমণের তালিকায় একদম প্রথমেই রয়েছে তাইল্যান্ড। এই দেশে বেড়াতে আসা এতটাই সুলভ যে, আজকাল অনেকে দেশের কোথাও না বেড়াতে গিয়ে ছুটি-ছাটায় ব্যাঙ্কক-পাটায়া চলে আসেন। তাইল্যান্ডে হালফিলের বহু বাংলা ছবির শ্যুটিংও হয়েছে।
সেই ব্যাঙ্ককে এমন বিস্ফোরণে চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন বহু বাঙালি। ইতিমধ্যে অনেকেই সেখানে পুজোর ছুটিতে বেড়ানোর প্ল্যান ছকে ফেলেছেন। রাজনৈতিক টালবাহানায় অনেক দিন তাইল্যান্ড অশান্ত ছিল। তবু তার বিশেষ প্রভাব বাঙালি, তথা ভারতীয় পর্যটকদের ওপর পড়েনি। কিন্তু আজকের এই বিস্ফোরণে চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন অনেকেই।
আজ বিস্ফোরণ স্থলের কাছেই ছিলেন বলিউডি দম্পতি রীতেশ দেশমুখ ও জেনেলিয়া ডি’সুজা। বিস্ফোরণের একটু পরেই রীতেশ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ইনস্ট্যাগ্রামে বিস্ফোরণ স্থলের এক ভিডিও পোস্ট করে বলেন, ‘‘চিন্তা করবেন না, আমরা দু’জনেই নিরাপদে আছি। যেখানে বোমা ফেটেছে, তার খুব কাছেই ছিলাম আমরা।’’
কেমন জায়গা এই রাচাপ্রাসং চৌমাথা?
তিন তিনটে ঝাঁ চকচকে শপিং মল, মেট্রোর জংশন, হাসপাতাল, কেন্দ্রীয় দূতাবাস, পাঁচতারা আর সাততারা হোটেলের সারি। এবং ব্রহ্মা মন্দির (বিদেশিরা বলেন, এরাওয়ান শ্রাইন)। সব মিলিয়ে সন্ধের রাচাপ্রাসং মানেই আলো ঝলমলে ব্যস্ততা। ব্রহ্মা মন্দিরের সুবাদে (স্থানীয় ভাষায় ফ্রা ফ্রমের মূর্তি) এখানে সব সময়েই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। ঠিক যেমন কলকাতার যে কোনও কালী মন্দিরে প্রতিদিনই ভক্তরা জড়ো হন। এরাওয়ানও খানিকটা সে রকম। হিন্দুদের পাশাপাশি প্রচুর বৌদ্ধও রোজ এই মন্দির দর্শনে আসেন। তাইল্যান্ডের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তো স্পষ্টই বলেছেন, মূলত বিদেশি পর্যটক, পর্যটন শিল্প আর অর্থনীতিতে ধাক্কা দেওয়ার জন্যই আজকের এই বিস্ফোরণ। তবে এত বড় হামলার পিছনে কাদের হাত রয়েছে, সে নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে পুলিশ। কোনও জঙ্গি সংগঠন এখনও পর্যন্ত এর দায় স্বীকার করেনি।
বিস্ফোরণের পরে ব্রহ্মা মন্দিরের সামনের রাস্তাটায় তৈরি হয়েছ একটা ছ’ফুট গভীর গর্ত। প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুত চান-ও-চা অবশ্য বলছেন, পরিস্থিতি তাঁর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। দেশে আপৎকালীন অবস্থা জারি হয়েছে বলে যে গুজবের ঝড় উঠেছে, তা-ও তিনি নাকচ করে দিয়েছেন।
তবে আজকের এই বিস্ফোরণ ব্যাঙ্ককবাসীর বিশ্বাসের ভিতটা ভাল মতোই নড়বড়ে করে দিয়েছে। শান্তিপ্রিয় এই শহর এত বড় মাপের
বিস্ফোরণ চাক্ষুষ করেনি সাম্প্রতিক অতীতে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জোড়া বিস্ফোরণে কেঁপেছিল ব্যাঙ্কক। সেটাও এই রাচাপ্রাসাং এলাকায়। তবে আজকের তুলনায় সেই বিস্ফোরণ ছিল খুবই ছোট মাপের। কেউ হতাহত হননি। ২০১২ সালেও ব্যাঙ্ককে একটা বিস্ফোরণ হয়েছিল বটে। তাতে আহত হয়েছিলেন পাঁচ জন। তার পর রাজপথে এত রক্ত একসঙ্গে দেখলেন ব্যাঙ্ককবাসী। সন্ধে থেকেই স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে রাচাপ্রাসংয়ের রক্তাক্ত দৃশ্য। কোথাও পড়ে রয়েছে মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহাংশ। কোথাও বা বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া কঙ্কালসার গাড়ি। যে মলে আজ আমার যাওয়ার কথা ছিল, সেখান থেকেও নাকি মিলেছে একটি তাজা বোমা। স্থানীয় একটি দৈনিক বলছে, পুলিশ এখনও পর্যন্ত দু’টি বোমা নিষ্ক্রিয় করেছে।
আপাতত কোনও জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আঙুল না তুললেও পুলিশের নজর কিন্তু রয়েছে দক্ষিণের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দিকে। এমনিতেই শাসক-বিরোধী দীর্ঘ টানাপড়েনে দীর্ণ এখানকার রাজনীতি। গত কয়েক বছর ধরে অনেক প্রতিবাদ-আন্দোলন দেখেছে রাচাপ্রাসং চত্বর। এতটাই যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট সেন্টারের ঠিকানাও বদলানো হয় তার জন্য। আগামী সপ্তাহে শুরু হচ্ছে নতুন সেমিস্টার। দেশ-বিদেশ থেকে ছাত্ররা ইতিমধ্যেই আসতে শুরু করেছে। তাদের নিরাপত্তা এখন সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা আমাদের।
তাইল্যান্ডে ভারতের রাষ্ট্রদূত হর্ষ বর্ধন শ্রিঙ্গলা জানিয়েছেন, কোনও ভারতীয় জখম হননি। এখানকার ভারতীয়দের সুবিধার্থে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক দু’টি হেল্পলাইন নম্বরও চালু করেছে। টিভিতেই দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দুবাইয়ের মঞ্চ থেকেই এই হামলার কড়া নিন্দা করেছেন।
(লেখক তাইল্যান্ডের ওয়েবস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং এবং এনরোলমেন্ট বিভাগের ডিরেক্টর)