সোভিয়েতের পতন।
মার্কিন সাংবাদিক জন রিড ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় গিয়ে বলশেভিক বিপ্লবকে খুব কাছ থেকে দেখে লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’। সেই গ্রন্থে রিড লিখেছিলেন যে ১৯১৭-র মার্চ মাসে জারের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটার সময় রাশিয়ার বিত্তশালী শ্রেণিগুলি শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিপ্লব চেয়েছিল, যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে আসবে তাদের হাতে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত রাশিয়ার শ্রমিক, কৃষক-সহ শ্রমজীবী জনগণের বড় অংশই তাতে সন্তুষ্ট ছিল না, তারা চাইছিল যুদ্ধের সমাপ্তি আর শিল্প এবং কৃষিক্ষেত্রের ব্যাপক গণতান্ত্রিকরণ। সেই আকাঙ্খারই ফলস্বরূপ ১৯১৭-র নভেম্বর মাসে ‘রাজনৈতিক বিপ্লবের’ পিঠে আর একটি ‘সামাজিক বিপ্লব’ ঘটে, যার মধ্যে দিয়ে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে সফল হয়।
এই সামাজিক বিপ্লবের পরে রাশিয়ায় গড়ে ওঠে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, যা ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। সেই সময় থেকে ১৯৯১ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন অবধি, বলশেভিক বিপ্লবের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও মতাদর্শগত প্রভাব ছিল সমস্ত বিশ্বজুড়েই। ইতিহাসবিদ এরিক হবসবম এই সময়কালকেই আখ্যায়িত করেছেন ‘স্বল্পমেয়াদি বিংশ শতাব্দী’ (the short twentieth century) বলে। এখন প্রশ্ন হল, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ২৬ বছর পরে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, ঠিক ১০০ বছর আগে ঘটা বলশেভিক বিপ্লবের আর কি কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে? থাকলেও তা কী ভাবে?
উন্নত পুঁজিবাদী কোনও দেশে বিপ্লব না হয়ে, রাশিয়ার মতো তুলনামূলক ভাবে পিছিয়ে পড়া একটি দেশে যে প্রথম সর্বহারার বিপ্লব হবে সেটা কার্ল মার্কস নিজেও কিন্তু ভাবেননি। রাশিয়ার বলশেভিকরা পুঁজিবাদ ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রের মার্কসীয় সমালোচনার মূল কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে তাত্ত্বিক ভাবে অনেক কিছুই উদ্ভাবন করেছিলেন। তত্কালীন বিশ্বপরিস্থিতি এবং রাশিয়ার বাস্তবতার উপরে ভিত্তি করে নিজেদের স্বকীয় এক বোঝাপড়ায় উপনীত হতে পেরেছিলেন। বিংশ শতাব্দীতে রাশিয়ার পরে চিন, কিউবা বা ভিয়েতনামেও যখন বিপ্লব হয়েছে, সে ক্ষেত্রেও এই দেশগুলির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য মেনে মার্কসবাদের উদ্ভাবনী প্রয়োগ ঘটানো হয়।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই যখন গোটা বিশ্বে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে, তখন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সোভিয়েত ইউনিয়ন-সহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট শাসকরা অবশেষে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় এবং ওখানে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। আবার চিন বা ভিয়েতনামের শাসকেরা নামে এখনও কম্যুনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক হয়ে থাকলেও বাস্তবে তারা মার্কসবাদের প্রয়োগের থেকে অনেককাল আগেই দূরে সরে গেছে।
কেন এমন হল? এটা উল্লেখযোগ্য যে গত শতাব্দীতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যে দেশগুলিতে হয়েছিল তার কোনওটাতেই প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র ছিল না। সেই বিপ্লবের অভিমুখ ছিল হয় স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র অথবা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে। তাই বিপ্লবগুলিকে বাস্তবায়িত করতে শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, তার সঙ্গে সামরিক অভিযানও চালাতে হয়েছিল। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের পরে, বিপ্লবোত্তর রাষ্ট্রগুলি পরিণত হয় এক-পার্টির একনায়কতন্ত্রে যেখানে সামরিক বাহিনী-সহ পার্টি ও রাষ্ট্রের একীকরণ ঘটে। এই একনায়কতন্ত্রের দ্বারা এক দিকে যেমন পার্টি-রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ভিন্নমত ও গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়, অন্য দিকে সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকারও খর্ব করা হয়। এর ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই পার্টি ও রাষ্ট্রের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে।
তার উপর, কমান্ড-অর্থনীতি নির্ভর কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক মডেল, যার সৃষ্টি হয়েছিল দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সম্পদের সমবণ্টন করার লক্ষ্যে, তা ধীরে ধীরে একটি আমলাতান্ত্রিক যান্ত্রিকতায় পর্যবসিত হয়। এই আমলাতন্ত্রে অর্থনৈতিক ভাবে কাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তা নিয়ে জটিল সমস্যা তৈরি হয়। এর একটি বড় উদাহরণ ছিল মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলিকে অবজ্ঞা করে সামরিক ক্ষেত্রে বা পারমাণবিক অস্ত্রের পিছনে প্রচুর সম্পদ ব্যয় করা। শুধু সম্পদের অপচয়ই নয়, আমলাতান্ত্রিকতার ফলে থমকে যায় প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং আর্থ-সামাজিক প্রগতি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উপনিবেশকতার পতন ও ১৯৭০-র দশক থেকে আর্থিক বিশ্বায়ন সমাজতান্ত্রিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে আরো জটিলতার সৃষ্টি করেছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যেই আন্তঃ সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব তীব্রভাবে বিদ্যমান ছিল, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চল এবং উপনিবেশের দখল নেওয়ার জন্য এই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে দুটি বিশ্বযুদ্ধও হয়, সেই দ্বন্দ্ব গত শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধে স্থিমিত হয়ে আসে। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বে ন্যাটো, জি-৭ বা হালে জি-২০’র মতো পুঁজিবাদী দেশসমূহের মিলিত মঞ্চ তৈরি হয়েছে। আর্থিক পুঁজি ও প্রযুক্তির বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের বৃহৎ দেশগুলি এখন বিশ্ব অর্থনীতির মানচিত্র খানিকটা উল্টেপাল্টে দিয়েছে। চিন, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি ‘উদীয়মান’ অর্থনীতিগুলি বিশ্ব-পুঁজিবাদী আর্থিক বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ কুশীলবের ভূমিকা পালন করছে। তাই বলা যেতে পারে যে বর্তমান বিশ্ব যে সন্ধিস্থলে এখন দাঁড়িয়ে তা ১০০ বছর আগে বলশেভিক বিপ্লবের সময়ের আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব এবং বিশ্বযুদ্ধের সন্ধিক্ষণ থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা।
এই ‘উদীয়মান’ অর্থব্যবস্থাগুলিতে বিশ্বায়নের পর থেকে পুঁজিবাদী বিকাশ ত্বরাণ্বিত হয়েছে যার মধ্য দিয়ে এই দেশগুলির কর্পোরেট পুঁজিও আজ বহুজাতিক পুঁজিতে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদী উন্নয়নের ফলে এই দেশগুলির মধ্যেকার সমাজ কিন্তু শুধু পুঁজিপতি এবং শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজিত হয়নি। বরং, এক বিশাল আকারের অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্ম হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক অংশ স্বনিযুক্ত ছোট বা ক্ষুদ্র উৎপাদক এবং বাকি অর্ধেক ঠিকাশ্রমিক বা দিনমজুর, যাদের কাজ বা রোজগারের কোনও সুরক্ষা নেই। শ্রমিক শ্রেণির একমাত্রিকতার বদলে তাই দেখা দিচ্ছে তাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের স্তর, যাদের স্বার্থ সব সময়ে একখাতে বইছে না। তাই একটি স্লোগানের ভিত্তিতে সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তদুপরি লিঙ্গ, জাতপাত, জাতি-বর্ণ-ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন প্রকারের বৈষম্যের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে চেতনা বেড়েছে, যার ফলে গোঁড়া শ্রেণি-সংগ্রামভিত্তিক রাজনীতি, যা এই বিবিধ প্রকারের সামাজিক বৈষম্য নিয়ে চিন্তিত নয়, ক্রমে তার প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। বর্তমান পুঁজিবাদের প্রেক্ষাপটে তাই শোষিত শ্রমজীবী মানুষকে রাজনৈতিক ভাবে একজোট করার জন্য এই জটিলতাগুলিকে মাথায় রেখে অর্থনৈতিক ন্যায়ের সঙ্গে সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নকে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত করে বর্তমান সময়ের উপযোগী সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচির রূপরেখা তৈরি করতে হবে।
কার্ল মার্কস সারা জীবন লাগিয়েছিলেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ইতিহাস ও তার গতিপ্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করতে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সম্পর্কে মার্কসের সমালোচনার নির্যাস ছিল এই যে, এই ব্যবস্থা যেহেতু শ্রমজীবী মানুষের শোষণের মাধ্যমেই মুনাফা কামায় এবং মুনাফার পাহাড় জমতে জমতে পুঁজির কেন্দ্রীভবনও ঘটে, তাই আর্থিক বৈষম্য পুঁজিবাদের মধ্যে চিরকালই থাকবে। সমাজে এক দিকে তৈরি হবে মুষ্টিমেয়দের প্রাচুর্য, অন্য দিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে দারিদ্রে। তদুপরি, এই ব্যবস্থায় সমস্ত মানুষের কর্মসংস্থানও নিশ্চিত করতে পারবে না, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে ক্রমে শ্রমের চাহিদা কম হতে থাকায়। আবার যেহেতু এই ব্যবস্থা অস্থিতিশীল ও অরাজক, পুঁজিবাদ বিভিন্ন সময়ে হয়ে পড়ে সঙ্কটগ্রস্ত, যার জেরে আসে মন্দা, বাড়ে বেকারত্ব।
টমাস পিকেটির পুঁজিবাদী বিশ্বে বাড়তে থাকা আর্থিক বৈষম্য সংক্রান্ত সাম্প্রতিক গবেষণা বা ২০০৯ পরবর্তী বিশ্বে চলতে থাকা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা অথবা বর্তমান দুনিয়ার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের চরিত্র যা মানুষের শ্রমকে ‘আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা করছে— মার্কস পুঁজিবাদের যে সমস্ত সমস্যাকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। শুধুমাত্র যাদের কায়েমি স্বার্থ রয়েছে এই বৈষম্যপূর্ণ স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখার, তারাই দেখতে চাইছে না পরিবেশ ধ্বংস ও বিশ্বউষ্ণায়ন-সহ নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বহুমুখী সঙ্কটকে। এই সঙ্কট থেকে বেরোতে এবং ভবিষ্যতে এক স্থিতিশীল, জনমুখী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা নির্মাণ করার জন্য মার্কসবাদ ও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ, মানুষের চিন্তন ও কল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে থাকবে। সেই নিরিখে, বলশেভিক বিপ্লব, যা ছিল সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম বার একটি পুঁজিবাদের বিকল্প সমাজ নির্মাণের প্রয়াস, ভবিষ্যতেও মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগাবে।