কামদুনির নির্যাতিতার পরিত্যক্ত বাড়ি। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
কাঁধে ব্যাগ, মাথায় ছাতা। সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে ডিরোজিও কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছে মেয়ে। পিছন-পিছন বাবা।
এক বছর আগে এই দিনেই ওই রাস্তা দিয়ে ফিরছিল আর এক মেয়ে। ওই কলেজেরই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীটিকে নিতে আসতে তার ছোট ভাইয়ের দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই পরীক্ষা দিয়ে একাই ফিরছিল সে। উঁচু পাঁচিল-ঘেরা পরিত্যক্ত কারখানায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। পরদিন গণধর্ষিতা মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত দেহটি কারখানার পিছনের পাঁচিলের বাইরে পেয়েছিলেন এলাকাবাসী।
আজও মেয়েকে একা ওই রাস্তায় ছাড়েন না কামদুনির কোনও বাবা-মা। রাস্তা সে দিন নিরাপদ ছিল না, আজও নয়। খড়িবাড়ি আর বারাসত বিডিও অফিস, দু’দিক দিয়েই ঢোকা যায় কামদুনিতে। এ দিন গিয়ে দেখা যায়, দু’পাশে ঢোকার মুখেই রয়েছে পুলিশ পিকেট। কিন্তু সেই সাড়ে চার কিলোমিটার পিচ-ওঠা রাস্তা রয়েছে ঠিক আগের মতোই। রাস্তা ঠিক করার কথা থাকলেও তা হয়নি। দাবি ছিল, রাস্তায় আলো বসাতে হবে। বসেনি আলোও। রাস্তার অধিকাংশই অন্ধকারে। অটো, ম্যাজিক ট্যাক্সি চালানোর প্রতিশ্রুতিও রাখা হয়নি।
এ দিনও দু’পাশে ভেড়ি আর নির্জন এলাকা দিয়ে হেঁটে-হেঁটে কামদুনিতে ঢুকতে দেখা গেল স্কুলছাত্রীদের। অনেকের সঙ্গে রয়েছেন অভিভাবক। এক ছাত্রী বলল, “আমরা হয় দল বেঁধে ফিরি, না হলে বাড়ির লোক থাকে। এ রাস্তায় একা চলা যায় না।” এক অভিভাবকের মন্তব্য, “ত্রিফলা আলো? দিনে সূর্য, রাতে চাঁদই ভরসা আমাদের।”
যে পরিত্যক্ত কারখানায় ওই তরুণীর উপরে অত্যাচার চলেছিল, পরে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ দিন দেখা যায়, সেই ছাই ঘরে ছড়িয়ে রয়েছে। বিশাল পাঁচিলের আড়ালে নানা দুষ্কর্ম চলে, অভিযোগ তুলে পাঁচিলটির একাংশ ভেঙে দিয়েছিল জনতা। দাবি ছিল, গোটা পাঁচিল ভেঙে সেখানে স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি তৈরি করতে হবে। ফাঁড়ি হয়নি। ভাঙেনি পাঁচিল। উল্টে ভাঙা পাঁচিল ঠিক করে আরও উঁচু করে উপরে কাঁচ বসানো হয়েছে। যাতে কেউ পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকতে না পারে।
তবে কি নতুন কিছুই হয়নি? হয়েছে বইকী। টুম্পা কয়াল, মৌসুমী কয়ালের মতো মেয়েদের মুখ, ওঁদের কথা, পরিচিত হয়ে উঠেছে রাজ্যের মানুষের কাছে। গত বছরও জামাইষষ্ঠীর জন্য কামদুনিতে বাপের বাড়িতে এসেছিলেন টুম্পা। মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন শুনে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে যান তিনি। এ বারেও জামাইষষ্ঠীতে কামদুনির বাড়িতে টুম্পার আক্ষেপ, বন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা দিদিকে বলতে গিয়ে ‘মাওবাদী’ তকমা জোটে। “সবে বিয়ে হয়েছে। আতঙ্ক ছিল। ভয় পেয়ে-পেয়ে সব ভয় কেটে গিয়েছে,” বলেন টুম্পা।
“আমরা আন্দোলন চালিয়েই যাব,” বললেন আর এক প্রতিবাদী মৌসুমী কয়াল। তাঁর কথায়, “ভয় তারাই দেখায়, যাদের ভয় আছে। আমাদের কীসের ভয়? যতদিন বাঁচি, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাব।”
প্রতিবাদ অবশ্য কেবল কামদুনিতেই সীমাবদ্ধ নেই। ওই ঘটনা নিয়ে উত্তাল হয় রাজ্য। গড়ে ওঠে কামদুনি প্রতিবাদী মঞ্চ, যার সমর্থনে রাস্তায় নামেন রাজ্যের বিশিষ্টজনেরাও। জনমতের চাপে সিআইডি তদন্তভার নেয়। ৯ জন ধরা পড়ে। এখন ব্যাঙ্কশাল আদালতে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে গোপন ক্যামেরায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। আজ, শনিবার কলকাতার মেট্রো চ্যানেলে ‘কামদুনি দিবস’ পালন করা হবে। থাকবেন টুম্পা, মৌসুমী-সহ কামদুনির গ্রামবাসীদের একটি বড় অংশ। শুক্রবার বেলা দু’টোয় টুম্পা ও মৌসুমীর সঙ্গে বসে বৈঠক করেন কামদুনি স্কুলের শিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। সেখানেই ঠিক হয়, আজ, শনিবার কামদুনি দিবসে যোগ দেবেন কামদুনির বাসিন্দারা।
কিন্তু কত অন্যায়, কত বঞ্চনার প্রতিবাদ করবে কামদুনি? এ দিন এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, কামদুনি মাঠে ফুটবল প্রতিযোগিতার পরে স্থানীয় খেলোয়াড়দের কলকাতায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সে সব কিছুই হয়নি। এলাকার কয়েক জন তৃণমূল কর্মীও জানান, মন্ত্রীদের আশ্বাসে রাস্তা হবে ধরে নিয়ে তাঁরা ঋণ নিয়ে গাড়ি কেনেন। সেই গাড়ি বসে রয়েছে। কিস্তির টাকা গুনতে হচ্ছে। রুটের অনুমতি মিলছে না।
ক্ষোভ নিহত মেয়েটির পরিবারেও। ঘটনার পরে পরিবারকে এক লক্ষ টাকার আর্থিক সাহায্য ও চাকরিও দেওয়া হয়। মৃতার বাবাকে নিয়োগ করা হয় উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদে। ভাই চাকরি পান স্মল অ্যান্ড মাইক্রো স্কেল ইন্ড্রাস্ট্রিজ-এ চতুর্থ শ্রেণির কর্মী হিসেবে। বিমলবাবুর স্ত্রীকেও চাকরি দেওয়া হয় মৃতার ভাইয়ের দফতরেই। এ দিন মৃতার ভাই বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী এক মাস সময় নিয়েছিলেন। এক বছর পেরিয়ে গেল, বিচার চলছেই। সরকারের তরফে যে ক’টি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার একটাও রাখা হয়নি। রাস্তা হয়নি, আলো আসেনি, অটো-বাস চালু হয়নি। পুলিশের স্থায়ী ক্যাম্পটাও তৈরি হল না। আমাদের তিন জনের চাকরিও পাকা হল না। বাবা-মার শরীরও খুব খারাপ।’’
কী বলছে সরকার? তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে কামদুনির সব পরিবারকে অন্ত্যোদয় কার্ড দেওয়া হয়েছে। মৃতার পরিবারকে চাকরি, সাহায্য করা হয়েছে। ক্লাবগুলিকে সাহায্য করা হয়েছে।” তাঁর দাবি, অটো, ম্যাজিক ট্যাক্সি চলবে। রাস্তা, আলোর টেন্ডারও হয়ে গিয়েছে। ভোটের জন্য আটকে ছিল, জেলা প্রশাসন কাজ শুরু করবে। “সময় না দিয়ে শুধু অভিযোগ করলেই তো হবে না,” বলেন মন্ত্রী। জেলাশাসক সঞ্জয় বনসল জানান, “বিদ্যুতের বিষয়টি জেলা প্রশাসন দেখে না। রাস্তা কী অবস্থায় রয়েছে, তা দেখছি।”