সারদা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোন কোন বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত করবে, তা নিয়ে জটিলতা এখনও অব্যাহত। সুপ্রিম কোর্ট এই ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়ার পরেও অস্পষ্টতা রয়েছে বলে প্রতারিতদের অভিযোগ।
একের পর এক বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার হাতে প্রতারিতরা শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন। চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে শাসক দলের অন্দরে যেমন জলঘোলা চলছে, চিট ফান্ডের মামলাও আদালতে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে। প্রতারিতদের কারও দাবি, সুপ্রিম কোর্ট টাকা ফেরানোর বন্দোবস্ত করুক। কারও আবার দাবি, এই কেলেঙ্কারির তদন্তে সুপ্রিম কোর্টই সিট গঠন করে দিক।
শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের ৯০টি অর্থলগ্নি সংস্থার হাতে প্রতারিতরা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানান। এগুলোর কোনওটাই সুদীপ্ত সেনের সারদা গোষ্ঠীর সংস্থা নয়। প্রতারিতদের দাবি, অর্থলগ্নি সংস্থার হাতে প্রতারিত হয়ে পুলিশে অভিযোগ জানালেও তাঁরা টাকা ফেরত পাননি। সিবিআই তদন্ত শুরু করলেও তাঁদের কোনও সুরাহা মেলেনি। আবেদনকারীদের আইনজীবী চিন্ময় খালিদকর জানান, এই সংস্থাগুলির হাতে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ প্রতারিত হয়েছেন। এই সংস্থাগুলি বাজার থেকে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা তুলেছে। কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কেউ আবার খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের ব্যবসা চালানোর নামে বেআইনি ভাবে বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করছিল। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা সেবি, কারও অনুমতি মেনেই টাকা তোলা হয়নি। বিচারপতি টি এস ঠাকুর ও বিচারপতি আদর্শ কুমার গোয়েলের বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিরই তদন্তের ভার সিবিআইকে দেওয়া হয়েছে। আদালতে আবেদনকারীরা সিবিআইয়ের কাছে বিষয়টি জানান।
গত বছরের ৯ মে সারদা কেলেঙ্কারির সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার সময়, পশ্চিমবঙ্গে অন্য সব বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগেরও সিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সারদা-কাণ্ডে তৃণমূল নেতাদের ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে সিবিআই তদন্তের আর্জি জানিয়েছিল। সেই আবেদনের শুনানির সময় সিবিআই জানায়, তারা সব মামলার তদন্ত করতে চায় না। কারণ সিবিআইয়ের এত লোকবল নেই। শুধু যে সব কেলেঙ্কারির পিছনে বৃহত্তর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে, সেগুলিরই তদন্ত করতে চায় সিবিআই। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, নির্দেশ অনুযায়ী সিবিআই সমস্ত মামলার তদন্ত করতে দায়বদ্ধ। এখন সিবিআই যদি বাছাই করা কিছু মামলার তদন্ত করতে চায়, তা হলে সেই অনুযায়ী কোর্টে আবেদন জানালে আগের নির্দেশে রদবদল করা হবে।
সিবিআই আদালতে এখনও সেই আবেদন জানায়নি। ফলে কোন সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত করবে, আর কোনগুলির বিরুদ্ধে করবে না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। সেখানেই দেখা দিয়েছে মুশকিল। আইনজীবী চিন্ময় খালিদকর বলেন, “সারদা ছাড়া অন্য সংস্থার হাতে প্রতারিতরাও নিরপেক্ষ তদন্ত চাইছেন। তাঁদের টাকা ফেরত দেওয়ার কী বন্দোবস্ত হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শ্যামল কুমার সেনের নেতৃত্বে কমিশন তৈরি হয়েছিল। সেখান থেকেও অনেকে সুরাহা পাননি বলে অভিযোগ। আগামী সপ্তাহে আরও বেশ কিছু সংস্থার হাতে প্রতারিতরা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানাবেন। সুপ্রিম কোর্ট নিজেই যাতে একটি সিট গঠন করে দিয়ে তদন্ত ও টাকা ফেরতের বন্দোবস্ত করে, তারই আর্জি জানানো হবে।” সিবিআই রাজ্য জুড়ে অজস্র সংস্থার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলার তদন্ত করতে রাজি নয়। সিবিআইয়ের যুক্তি, শীর্ষ আদালত চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির পিছনে বৃহত্তর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে যে সব সংস্থার প্রতারণার পিছনে কোনও বৃহত্তর ষড়যন্ত্র নেই, সেগুলি সিবিআইয়ের হাতে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রতারিতদের আবেদনে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, অন্যান্য অনেক সংস্থাও সারদার মতোই পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি বিহার, অসম, ঝাড়খণ্ডের মতো প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতেও জাল বিছিয়েছিল। সিবিআই দায়িত্ব ছেড়ে দিলেও সেগুলির তদন্ত রাজ্য পুলিশের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
পশ্চিমবঙ্গ ও প্রতিবেশী রাজ্যগুলি জুড়ে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার দৌরাত্ম্যের জন্য শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা ফের সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিচারপতি ঠাকুর মন্তব্য করেন, “সিবিআইকে সেবি ও আরবিআইয়ের ভূমিকার তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছি। যদি নিয়ন্ত্রকরাই অন্ধ সেজে থাকে, তারও তদন্ত প্রয়োজন। যদি কোনও অফিসার যড়যন্ত্রে জড়িত থাকেন, তারও তদন্ত প্রয়োজন।”
সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, সেবি-র অন্তত আট জন অফিসারের নাম এখনও পর্যন্ত তদন্তে উঠেছে। কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রকের জালিয়াতি তদন্ত সংস্থা এসএফআইও-র রিপোর্টেও সেবি-র অফিসারদের নাম ছিল। তদন্তকারীরা সেবি-র এক সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সারদার বিরুদ্ধে ৭৬টি মামলা একসঙ্গে করে ৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সারদা ছাড়া অন্যান্য সংস্থার বিরুদ্ধে ৬৫টি মামলা একজোট করে ৯টি মামলা হয়েছে। আর কোন মামলা সিবিআই হাতে নেবে, কোনগুলি নেবে না, তা নিয়ে অবশ্য সিবিআই কর্তারা এখনও মুখ খুলতে রাজি নন। তাঁদের বক্তব্য, সব মামলা খতিয়ে দেখেই তার পরেই সুপ্রিম কোর্টে জানানো হবে।