শিল্পায়নের নামে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করার বিরুদ্ধে একরোখা আন্দোলনই ছিল রাজ্যপাট দখলে তৃণমূল কংগ্রেসের সেরা বাজি।
ক্ষমতা দখলের পরে কৃষি জমির হাল নিয়ে উদাসীন কেন রাজ্য সরকার?
কৃষিজমি হারিয়ে যাওয়া নিয়েই আন্দোলন ছিল পরিবেশবিদদের। তাঁদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণও ছিল। নানা রাজ্যে আবাদি জমির হালহকিকত সংক্রান্ত ২০১৩-১৪-র কৃষি মন্ত্রকের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, প্রতি পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৪.৮৫ শতাংশ কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। সে ব্যাপারে রাজ্য সরকার যে ‘নিষ্ক্রিয়’, কৃষিমন্ত্রকের রিপোর্টে তারও উল্লেখ ছিল।
এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের উদাসীনতার বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করেছিল এক পরিবেশপ্রেমী সংগঠন। মঙ্গলবার পরিবেশ আদালত সেই মামলা গ্রহণ করার পাশাপাশি জানিয়ে দিয়েছে, বিষয়টি উদ্বেগজনক। বিচারক প্রতাপ রায় এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে রাজ্য এবং বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থার মধ্যে সমন্বয় রেখে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। দেশের শীর্ষ আদালতের নির্দেশ ছিল, কোনও ভাবেই কৃষিজমিতে ইটভাটা করা যাবে না। গড়া যাবে না কোনও তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্রও। কৃষিজমির মাটি নয়, তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্রের ‘ফ্লাই অ্যাশ’-ই ইট ভাটার প্রাথমিক উপকরণ বলে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট।
সেন্ট্রাল সয়েল অ্যান্ড ওয়াটার কনজারভেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট-এর (সিএসডব্লুসিআরটিআই) হালের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ভারী শিল্পের জমিগ্রাসের উল্লেখ না থাকলেও, বিভিন্ন জেলায় গজিয়ে ওঠা ইটভাটার থাবা পড়েছে চাষের জমিতে। যার ফলে প্রতি বছরই রতুয়া থেকে রায়দিঘি, কয়েক হাজার হেক্টর আবাদি জমি যাচ্ছে ভাটার দখলে। সমীক্ষায় প্রকাশ, ইটভাটার দখলদারির সঙ্গেই দক্ষিণবঙ্গে কয়েকটি জেলায় মাছ চাষ, শহরাঞ্চল লাগোয়া এলাকায় আবাসন ব্যবসার কোপ পড়েছে কৃষিজমির উপরে।
ওই সমীক্ষার সমর্থন মিলেছে বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টেও। ‘গ্রাম-শহরে জমির অবক্ষয়’ সংক্রান্ত বিশ্বব্যাঙ্কের ওই রিপোর্টেও নির্দিষ্ট ভাবেই দেখানো হয়েছে যে মালদহ, মুশির্দাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর থেকে দুই ২৪ পরগনা সর্বত্রই কৃষিজমির উপরে ইটভাটার দখলদারিতে জমির সব থেকে উপরের স্তরের মাটি (টপ সয়েল) ক্রমেই উর্বরতা হারাচ্ছে। ফলে বছর কয়েক পরে ভাটা মালিক তার কারবার গুটিয়ে নিলেও জমি আর ফলনযোগ্য থাকছে না। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, ফলে হুগলি এমনকী রাজ্যের শস্যগোলা বর্ধমানের বেশ কিছু এলাকায় পাঁচ বছর আগেও যে জমিতে বছরে তিন বার ফলন হত, তা বন্ধ্যা হয়ে পড়ছে।
কৃষি দফতরের কপালে যে বিষয়টি ভাঁজ ফেলেছে, তা কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর কথায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মাস কয়েক আগেই তিনি জানিয়েছিলেন, ব্যাপারটা ‘উদ্বেগজনক’। মন্ত্রী জানান, রাজ্যের আনাচ-কানাচে ইটভাটা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ইতিমধ্যেই পরিবেশ দফতরের সঙ্গে আলোচনা করেছেন কৃষিকর্তারা। সরকারি নথিই বলছে, রাজ্যে ইটভাটার সংখ্যা অন্তত ২২০০। রাতারাতি ওই ভাটাগুলি বন্ধ করে দেওয়া অসম্ভব, কবুল করেছেন মন্ত্রী। তা হলে উপায়?
সিএসডব্লুসিআরটিআই-এর বিশেষজ্ঞ টি শ্রীধরনের নিদান, “উপায় একটাই, সুপ্রিম কোর্টের আইন মেনে কৃষিজমি, ফলের বাগান, বনভূমি দখল করে ইটভাটা গড়া চলবে না।” ২০০২ সালে রাজ্যে কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ৫৫,২১,৫৭৬ হেক্টর। কৃষিমন্ত্রকের পরিসংখ্যান বলছে, পরবর্তী পাঁচ বছরে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫২,৯৬,০০৫ হেক্টরে। অর্থাত্ পাঁচ বছরে ২,২৫,৫৭১ হেক্টর কৃষিজমি ‘হারিয়ে’ গিয়েছে। ২০১২ সালে হ্রাস পেয়েছে আরও আড়াই লক্ষ হেক্টর কৃষি জমি। এই হারে জমি হ্রাস পেতে থাকলে আগামী আড়াই দশকের মধ্যেই রাজ্যে খাদ্যসঙ্কট অবশ্যম্ভাবী বলে মন্তব্য করেছেন কৃষিমন্ত্রকের কর্তারা।
রাজ্যের কৃষি দফতরের প্রাক্তন কর্তা তথা পরিবেশবিদ স্বদেশরঞ্জন মিশ্রের অভিজ্ঞতা, “ভাটা মালিকদের নগদ টাকার হাতছানিতে তিন থেকে পাঁচ বছরের লিজ-এ জমির মালিক চাষযোগ্য জমি ভাড়া দিচ্ছেন। কিন্তু পাঁচ বছর পরে তিনি যখন জমি ফেরত পাচ্ছেন, তখন তা নিছকই একটি বন্ধ্যা পতিত জমি।” তিনি জানান, জমিকে উর্বর রাখার অবশ্যম্ভাবী শর্ত, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, জিঙ্ক সব উপাদানই থাকে জমির উপরিভাগে। ভাটা মালিকরা সেই মাটিই ব্যবহার করেন ইট তৈরিতে। এ ব্যাপারে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন কর্তা তথা পরিবেশবিদ বিশ্বজিত্ মুখোপাধ্যায় বলেন, “ফি বছর প্রায় ২.২১ কোটি কিউবিক মিটার টপ সয়েল ইটভাটার আগুনে পুড়ছে। ফলে জমির উর্বরা শক্তি অচিরেই শূন্য হয়ে পড়ছে।”
আদালতের নির্দেশে সেই উদ্বেগ কি কমল? বিশ্বজিত্বাবুর কথায়, “রাজ্য আদালতের নির্দেশ মানলে তবেই না উদ্বেগ হ্রাস-বৃদ্ধির প্রশ্ন।”