শুধু ইতিহাসবিদের সংজ্ঞায় তাঁকে বাঁধা যায় না

অ্যান্টিবায়োটিকের এক প্রস্ত কোর্স শেষ হয়েছিল সে দিনই। বুধবার রাত ৯টা নাগাদ (ভারতীয় সময় রাত ১টা) অক্সফোর্ডের বাড়িতে, দেড় বছরের অসুস্থতাশেষে ৮৮ বছর বয়সে মারা গেলেন ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী। বাঙালির মানসিক ইতিহাস নিয়ে তাঁর বইটি অসমাপ্ত রয়ে গেল। সন-তারিখ আর দলিল-দস্তাবেজের নীরস ইতিহাস নয়, পরিণত বয়সে ‘বাঙালনামা’ কিংবা ‘রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তের পরচরিতচর্চা’-র মতো সরস আত্মজীবনী লিখে বাঙালি পাঠকের কাছে উজ্জ্বল উদ্ধার হয়ে আছেন তপনবাবু।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৭
Share:

অ্যান্টিবায়োটিকের এক প্রস্ত কোর্স শেষ হয়েছিল সে দিনই। বুধবার রাত ৯টা নাগাদ (ভারতীয় সময় রাত ১টা) অক্সফোর্ডের বাড়িতে, দেড় বছরের অসুস্থতাশেষে ৮৮ বছর বয়সে মারা গেলেন ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী। বাঙালির মানসিক ইতিহাস নিয়ে তাঁর বইটি অসমাপ্ত রয়ে গেল।

Advertisement

সন-তারিখ আর দলিল-দস্তাবেজের নীরস ইতিহাস নয়, পরিণত বয়সে ‘বাঙালনামা’ কিংবা ‘রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তের পরচরিতচর্চা’-র মতো সরস আত্মজীবনী লিখে বাঙালি পাঠকের কাছে উজ্জ্বল উদ্ধার হয়ে আছেন তপনবাবু। বরিশালের ক্ষয়িষ্ণু জমিদারবাড়ি... তলিয়ে যাওয়ার আগের আকুতি, সেখানকার কথ্য রসিকতা...সব মিলিয়ে দুটি বই-ই স্মৃতিকথার গণ্ডি ছাপিয়ে হয়ে উঠেছিল সামাজিক ইতিহাস। শেষ বাংলা বই ‘প্রবন্ধসংগ্রহ’তেও আকবরের আমলে শাক রান্না থেকে শুরু করে সুকুমার সেন পর্যন্ত হরেক বিষয়ের ভূরিভোজ।

বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে অনায়াস গতায়াত, সামাজিক ইতিহাসে সাহিত্যের রসবোধ নিয়ে আসাই ছিল তপনবাবুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যদুনাথ সরকারের শেষ গবেষক ছাত্র তিনি, মাঝে মাঝেই একটি ঘটনার কথা বলতেন। ‘ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব মুঘল এম্পায়ার’-এর শেষ খণ্ডের প্রুফ দেখা সবে শেষ, ছাত্র জিজ্ঞেস করলেন মাস্টারমশাইকে: ‘স্যার, এর পর কী?’ যদুনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘দেখো, এ রকম সাহিত্যসংক্রান্ত কাজের দায়িত্ব আর নেব না।’ মাস্টারমশাইয়ের প্রেরণাতেই ইতিহাস আর সাহিত্যের সীমারেখা বারংবার ভেঙে দিয়েছেন তিনি। যদুনাথের অধীনেই তৈরি হয়েছিল তাঁর থিসিস: বেঙ্গল আন্ডার আকবর অ্যান্ড জাহাঙ্গির, অ্যান ইন্ট্রোডাকটরি স্টাডি ইন সোশ্যাল হিস্ট্রি। মঙ্গলকাব্যকে যে ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়, সেখানেই দেখালেন তপনবাবু।

Advertisement

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের সেই সময়টায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকেই ইতিহাসের নতুন দিগদর্শনের কথা ভাবছিলেন। নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ, অমলেশ ত্রিপাঠী, অরুণ দাশগুপ্ত, রণজিৎ গুহ...। তপনবাবু সম্পর্কে সহকর্মী নরেন্দ্রকৃষ্ণকে বলেছিলেন যদুনাথ, ছাত্রটিকে নিয়ে তাঁর একটিই ভয়। মনটা সব সময় ‘হেথা নয় হেথা নয়’ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তপনবাবুর এই বিচিত্রগামী মনের পরিচয় পাওয়া গেল তাঁর পরের বইতেই। ওলন্দাজ ভাষা শিখে অক্সফোর্ডে লেখা থিসিস: ইয়ান কোম্পানি ইন করমণ্ডল। মধ্যযুগের অর্থনীতিতে বাণিজ্যিক পণ্যের কী অভিঘাত ছিল, তার অনুসন্ধান। দেশে ফিরে দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সে অধ্যাপনা, উক্ষতারণে (অক্সফোর্ডকে মজা করে এই মোক্ষমুলারীয় নাম দিয়েছিলেন তিনি) গিয়ে ইরফান হাবিবের সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদনায় ‘কেমব্রিজ ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’-র প্রথম খণ্ড। দ্বিতীয় খণ্ডের সম্পাদনায় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ধর্মা কুমার!

অতঃপর অর্থনীতির ইতিহাস ছেড়ে বঙ্গীয় রেনেসাঁসের চরিত্রসন্ধান। ‘ইউরোপ রিকনসিডার্ড’ বা ‘পারসেপশনস, ইমোশনস, সেন্সিবিলিটিজ’ এই সময়েরই ফসল। নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজে ইউরোপীয় অবদান বা দেশজ প্রতিবাদ... এর কোনও চশমাতেই নবজাগরণকে দেখেননি তিনি। দুধ আর লেবু মিলে যেমন ছানা নামে নতুন একটি পদার্থ তৈরি হয়, উনিশ শতকে বাঙালির নবজাগরণকে সে ভাবেই দেখেছিলেন তিনি। তপন রায়চৌধুরীর জাতীয়তাবাদী দৃষ্টি এ ভাবেই অনন্য। সেখানে সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতা বা আত্মম্ভরিতার কোনও স্থান ছিল না। তপন রায়চৌধুরী শুধু বৈঠকী মেজাজে হাসির কথা লিখতেনও না, উপযুক্ত চেতাবনিও দিতেন। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বারংবার সতর্ক করে গিয়েছেন: হিন্দু-মুসলমান বৈরিতা ব্রিটিশের তৈরি। মুঘল আমলে গরু জবাই নিয়ে মারপিট হয়েছে, কিন্তু দাঙ্গা হয়নি। প্রায়ই বলতেন, “৪৬-এ দাঙ্গা হয়েছিল, শহরের একটা ছোট অংশে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা ছিল। কিন্তু আজকাল অভিজাত ক্লাবে বা লেকের ধারে লোকজনকে অবলীলায় যে ধরনের কথাবার্তা বলতে শুনি, তা আরও ভয়ঙ্কর।”

বরিশালের এই বাঙালের আরও অবদান রয়েছে। তাঁর হাতেই বদলে গিয়েছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাসের পাঠ্যসূচি। তাঁর আগে, সেখানে ভারতীয় ইতিহাস পড়ানো শেষ হতো ওয়ারেন হেস্টিংসে এসে। ভারত? তার আবার ইতিহাস? অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ভারত মানে ‘প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইতিহাস’। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড এবং ফ্রান্সের সরবোন দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই ভারতীয় ইতিহাস মানে ‘ফার ইস্টার্ন স্টাডিজ’। তপনবাবুর হাত ধরেই বিলিতি পাঠ্যক্রমে ঢুকে পড়ে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, গাঁধী। ছাত্রও কম তৈরি করেননি। শাহিদ আমিন, জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়, সুরঞ্জন দাস, তপতী গুহঠাকুরতা সকলেরই প্রথম গবেষণার তত্ত্বাধায়ক ছিলেন তিনি। শেষ বার কলকাতায় থাকার সময় জাতীয় গ্রন্থাগারে কাজ করতে করতে প্রায়ই স্নেহভাজন গৌতম ভদ্রের ঘরে এসে বলতেন: ‘চা খাওয়াও।’ মজা করে সাব অলটার্ন হিস্ট্রিকে ‘হাবিলদার চর্চা’ লিখছেন ঠিকই, কিন্তু স্নেহের সম্পর্ক অটুট ছিল।

বৈঠকী মেজাজের সেই ছাত্রদরদী শিক্ষক, গবেষক ও সরস লেখক চলে গেলেন। নিছক ইতিহাসবিদ শিরোপায় যাঁকে বাঁধাই যায় না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement