ওঁরা নিজেরাই বলেন, আমরা মুখ্যমন্ত্রীর লোক। তৃণমূল নেতা আবু আয়েশ মণ্ডল দিদির নাম নিয়েই টোলপ্লাজায় কর্মীদের জুতো পেটা করেছিলেন। বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার সোনালি গুহ এ বার রাতবিরেতে আবাসনে হানা দিয়ে প্রবীণ চিকিৎসককে শাসিয়ে এলেন। হেঁকে বললেন, “আই অ্যাম দ্য ম্যান অব দ্য চিফ মিনিস্টার! আই অ্যাম দ্য গভর্নমেন্ট!”
দু’টো ঘটনারই সাক্ষ্য ধরা রয়েছে সিসিটিভি ফুটেজে।
রবিবার বিকেলে সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের চেয়ারম্যান আবু আয়েশ মণ্ডলের গাড়ি ডানকুনি টোল প্লাজায় আটকানো হয়েছিল। টোল চাওয়ার ‘অপরাধে’ সেখানকার কর্মীদের আবু জুতোপেটা করেন বলে অভিযোগ। সঙ্গে ছিল আস্ফালন “কাকে আটকাচ্ছিস জানিস? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন!”
বুধবার গভীর রাতে হাওড়ার গোলাবাড়ি এলাকার এক আবাসনে প্রায় তারই পুনরাবৃত্তি। লিফট সংক্রান্ত বচসা ঘিরে চিকিৎসক পিতা-পুত্র নগেন্দ্র ও নীতেশ রাইকে এক প্রস্ত মারধর, জুতোপেটা আগেই হয়ে গিয়েছিল বলে অভিযোগ। মমতার ঘনিষ্ঠ নেত্রী, সোনালি গুহ এসে পড়ার পরে চলল দেড় ঘণ্টা ধরে শাসানি। এ ব্যাপারে ডেপুটি স্পিকার-সহ আবাসনের এক পরিবারের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন নগেন্দ্রবাবু।
আবাসনের সিসিটিভি থেকে সোনালিদেবীর ধমকানি-চমকানির ছবি বৃহস্পতিবার সকালে টিভি চ্যানেলে ছড়িয়ে পড়তেই হইচই পড়ে যায়। কোথাও পারিবারিক কলহ, কোথাও শরিকি বিবাদ, কোথাও সালিশি সভা, কোথাও বা স্রেফ মাতব্বরি ছুতোয়নাতায় শাসক দলের ছড়ি ঘোরানোর প্রবণতা দিনদিন বাড়ছে বলেই বিরোধীদের অভিযোগ। আমজনতার অভিজ্ঞতাও বলছে, বাম জমানার শেষের দিকে যে উপসর্গ অতিকায় হয়ে দেখা দিয়েছিল, তৃণমূলের সাড়ে তিন বছরেই তা মহামারীর চেহারা নিয়েছে। আবাসনের ঘরোয়া বিবাদে ডেপুটি স্পিকারের মতো সাংবিধানিক পদাধিকারিণী যে ভাবে ছুটে গিয়ে তড়পে এলেন, তা এই চালচিত্রেরই অংশ মাত্র।
সোনালি অবশ্য আদৌ অনুতপ্ত নন। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, “আমি আমার নেত্রীর নির্দেশ পালন করেছি। এক জন মা হিসেবে, এক জন মহিলা হিসেবে আর এক জন অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে রক্ষা করতে আমি হাওড়ায় গিয়েছিলাম।’’ তাঁর দাবি, “আমি পাণ্ডবদের কাজ করেছি। মানে ভাল কাজ করেছি।”
কী রকম ‘ভাল কাজ’?
ঘটনার সময়কাল বুধবার রাত প্রায় দেড়টা। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, গোলাবাড়ি থানা এলাকায় সালকিয়া স্কুল রোডে একটি চারতলা আবাসনের উপরের তলায় সপরিবার বাস করেন নগেন্দ্র রাই নামে এক হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। তাঁর একমাত্র পুত্র নীতেশ রায় এবং পুত্রবধূও ওই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। নীতেশবাবুও পেশায় চিকিৎসক। নীচের তলার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন বেদপ্রকাশ তিওয়ারি নামে এক যুবক। আবাসনের অন্য বাসিন্দারা জানান, এই দুই পরিবারের মধ্যে গত কয়েক বছর ধরেই নানা বিষয়ে গোলমাল চলছিল। বুধবার রাতে আবাসনের লিফট বন্ধ থাকা নিয়ে নতুন করে গোলমাল বাধে।
নগেন্দ্রবাবুর অভিযোগ, আবাসনের নিয়ম অনুযায়ী লিফট চলার সময় সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা। কিন্তু বুধবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে লিফট খারাপ হয়ে যায়। এর পর রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ বেদপ্রকাশ ১৫-২০ জন বাইরের লোক নিয়ে চারতলায় উঠে আসেন। দরজায় কড়া নেড়ে নগেন্দ্রবাবুকে বাইরে ডাকেন। তার পরই বেধড়ক মারধর, জুতোপেটা চলে বলে অভিযোগ। ঘটনাটি ধরা রয়েছে আবাসনের সিসিটিভি ক্যামেরাতেও। তবে বেদপ্রকাশের পরিবারের পাল্টা অভিযোগ, তাঁদের বাড়িতে অন্তঃসত্ত্বা মহিলা আছেন জেনেও ওই চিকিৎসক ইচ্ছে করে লিফট বন্ধ করে রেখেছিলেন।
ঘটনাস্থলে সোনালিদেবীর আবির্ভাব আরও ঘণ্টাখানেক পরে। চিকিৎসকের অভিযোগ, রাত প্রায় দেড়টা নাগাদ তাঁরা যখন থানায় অভিযোগ দায়ের করতে যাচ্ছেন, তখনই হঠাৎ আবাসনের নীচে এসে দাঁড়ায় লালবাতি লাগানো সোনালি গুহর গাড়ি। সঙ্গে কয়েক জন পুলিশকর্মী। এর পর প্রায় দেড় ঘণ্টা আবাসনের গেটের সামনে দাঁড়িয়েই চলে ‘শাসানি’।
নগেন্দ্রবাবুর দাবি, “আমাকে নানা ভাবে অপমান করা হয়েছে। নিরাপত্তার কারণে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরা খুলে নেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন সোনালি। বলেছেন, আমাদের ফ্ল্যাটে তালা ঝুলিয়ে দেবেন।” এ দিন সকালে গোলাবাড়ি থানায় এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন নগেন্দ্র।
সোনালি অবশ্য শাসানির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর কথায়, “ডাক্তার রাই আমার পিতৃতুল্য। কিন্তু উনি যখন আমাকে বললেন বিজেপির ছেলেদের ডাকবেন, ডিজি-কে জানাবেন, তখন পুরনো সোনালি গুহ আমার মধ্যে জেগে উঠেছিল। কিন্তু দিদি (মুখ্যমন্ত্রী) আমাকে সব সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে বলেছেন। তাই আমি বলেছি, এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা, মোদীর বাংলা নয়। এখানে বজরঙ্গ দল বা করসেবক দিয়ে আমাদের চমকানো যাবে না।”
সোনালিকে জানানো হয়, তাঁর বক্তব্য তো সিসিটিভি-তে ধরা পড়েছে! সোনালির দাবি, “অনেকটাই ডাবিং করা হয়েছে। যেমন ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র শু্যটিং শেষ হওয়ার আগেই উত্তমকুমার মারা গিয়েছিলেন। পরে তাঁর কণ্ঠস্বর ডাবিং করে চালানো হয়েছিল। এখানেও তা-ই হয়েছে।” তাঁর কথায়, “আমি সরকারের লোক। আমার সামনে ওঁরা পুলিশকে অপমান করছেন দেখে আমি চুপ করে থাকব নাকি?” সোনালি বরং নগেন্দ্রবাবুর বিরুদ্ধেই পাল্টা মাতব্বরির অভিযোগ আনছেন। তাঁর দাবি, “আগেও হাওড়া পুরসভার ভোটের সময় ওঁর বিরুদ্ধে আমার কাছে অভিযোগ এসেছিল।”
কিন্তু যাই ঘটে থাকুক, বিধানসভার ডেপুটি স্পিকারকে ওই আবাসনে ছুটে যেতে হল কেন? এলাকায় তৃণমূলকর্মী বলে পরিচিত বেদপ্রকাশ জবাবে বলেন, “আমি ওঁর ‘রাখি ভাই’। ভাইয়ের কাছে দিদি আসতে পারেন না?” বেদপ্রকাশের বক্তব্য, তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। যে কোনও মুহূর্তে প্রসব যন্ত্রণা উঠতে পারে। এই কারণেই কয়েক মাস আবাসনের লিফট সারারাত চালু রাখার জন্য তিনি আবেদন করেছিলেন। দিদিও (সোনালি) একই আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু ওই চিকিৎসক তাতে বাদ সাধেন। এই নিয়ে অশান্তি চলছিল। বুধবারও তাই হয়েছে। তবে কাউকে মারধর করা হয়নি বলেই বেদপ্রকাশের দাবি।
সোনালিও মানছেন, বেদপ্রকাশ তাঁদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ। তাঁর বক্তব্য, বেদপ্রকাশের স্ত্রীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য লিফটে নামানোর দরকার ছিল। কিন্তু ডাক্তারবাবুর ‘নির্দেশে’ লিফট বন্ধ শুনেই তিনি আবাসনে যান। হাওড়ার পুলিশ কমিশনার অজেয় রানাডেকে ফোনে না-পেয়ে অতিরিক্ত কমিশনার শ্রীহরি পাণ্ডেকে বিষয়টি জানান। কথা বলেন সঙ্গীতার চিকিৎসক মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও।
হাওড়ার ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (সদর) নিশাদ পারভেজ এ দিন বলেন, “দু’পক্ষই থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”