রাজারহাট আছে রাজারহাটেই। হাজারো হইচই সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের এই শো-কেস উপনগরীতে সিন্ডিকেট-রাজের পরাক্রমে যে এতটুকু ভাটা পড়েনি, এ বার তা টের পেল টাটারাও।
রাজারহাটে সিন্ডিকেটের জুলুমবাজির নানা ঘটনা নানা সময়ে শিরোনাম হয়েছে। আবাসন হোক বা ব্যক্তিগত বাড়ি, মামুলি ব্যবসাদার হোন বা নামজাদা কর্পোরেট, সকলের উপরে সিন্ডিকেটের শ্যেন নজর। বাড়ি তৈরির ইট-বালি-সিমেন্ট কোথা থেকে কিনতে হবে, পাইপলাইনের কাজ কে করবে, এমনকী বাড়ি-অফিস বা আবাসনে সিকিওরিটি গার্ড কাদের রাখা হবে সবই ঠিক করে দেবে সিন্ডিকেট! তাদের ফরমান না-মেনে হেনস্থাও হতে হয়েছে অনেককে।
এবং সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে জর্জরিত ছোট-বড় সংস্থার লম্বা তালিকায় নবতম সংযোজন টাটা গোষ্ঠীর তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থা টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (টিসিএস)। রাজারহাটে চল্লিশ একর জমির উপরে টিসিএসের নিজস্ব ক্যাম্পাস গড়ে উঠছে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায় ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ, হাজার চারেক কর্মী সেখানে কাজও শুরু করে দিয়েছেন। চলতি বছরে দ্বিতীয় পর্যায় শেষ হওয়ার কথা। বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের (এসইজেড) তকমাযুক্ত ১৩৫০ কোটি টাকার প্রকল্পটিতে সব মিলিয়ে সাড়ে ষোলো হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্য। কিন্তু সেখানেই সাফাইকর্মী বা ইলেকট্রিশিয়ানের মতো বিভিন্ন পরিষেবার লোক নিয়োগ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ। যার জন্য সংস্থা-সূত্রে আঙুল তোলা হচ্ছে সিন্ডিকেটের দাদাগিরির দিকেই। কী রকম?
সূত্রের খবর, দেড় হাজার কোটি ডলারের সংস্থা টিসিএস এই সব পরিষেবার জন্য লোক নেয় ঠিকাদার মারফত। যাঁদের নেওয়া হচ্ছে, তাঁদের অতীত রেকর্ড খতিয়ে দেখা হয়। পুলিশের খাতায় নাম রয়েছে কি না, আগের কাজের জায়গায় আচার-ব্যবহার কেমন ছিল, এমন হরেক তথ্য যাচাই করেই নিয়োগ হয়। সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, এই প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু ইদানীং সিন্ডিকেটের লম্বা হাত এই নিয়মটাকেই উল্টে দিতে তৎপর। সিন্ডিকেট চাইছে, অতীত না-দেখেই তাদের পছন্দের লোক নিয়োগ করুক টিসিএস।
টিসিএস-কর্তৃপক্ষ এ প্রসঙ্গে সরকারি ভাবে মুখ খুলতে চাননি। এমনকী, প্রশাসনের কাছে আনুষ্ঠানিক কোনও অভিযোগও তাঁরা দায়ের করেননি। তবে সূত্রের দাবি, টাটাদের সংস্থাটি এ ব্যাপারে কোনও আপস করতে নারাজ। সিন্ডিকেটের অন্যান্য দাবি ‘বিবেচনায় রাখলেও’ পুরনো রেকর্ড খতিয়ে না-দেখে লোক নেওয়ার পথে তাঁরা কোনও ভাবেই হাঁটবেন না বলে জানিয়েছেন সূত্রটি।
কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন জবরদস্তির শিকার রাজারহাটের অনেকেই। আবাসন নির্মাতা বিভিন্ন নির্মাণসংস্থার অভিজ্ঞতা হরেদরে একই রকম। তারা জানিয়েছে, যে কোনও আবাসনে দশ থেকে কুড়ি জন নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াও রক্ষণাবেক্ষণের একাধিক কর্মী লাগে। শতাংশের হারে এদের মধ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক লোক সিন্ডিকেট থেকেই নিতে হয়। এক নির্মাণসংস্থার কর্তার কথায়, “এটা কার্যত অলিখিত আইনে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। না-মানলেই ঝামেলা।”
এমতাবস্থায় ওঁরা ঝঞ্ঝাট এড়াতে সিন্ডিকেটের সঙ্গে রফায় আসতে বাধ্য হন। সিন্ডিকেটের ‘সাপ্লাই করা’ কিছু লোককে রাখতেই হয়। স্বভাবতই এতে বহু সময়ে নিয়োগের গুণগত মান বজায় থাকে না। “কিন্তু এ ছাড়া উপায় কী? বেশি কড়া হতে গেলে গোটা প্রজেক্টই হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে।’’ মন্তব্য এক নির্মাণ-ব্যবসায়ীর।
টিসিএস অবশ্য কর্মীদের গুণগত মান নিয়ে তিলমাত্র আপস করতে রাজি নয়। কী উপায়ে তারা সমস্যা সামলাবে, সংস্থা-সূত্রে তার কোনও ইঙ্গিত মেলেনি। বস্তুত এর আগে সিন্ডিকেটের নানাবিধ অত্যাচার মোকাবিলায় বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন কৌশল নিয়েছে। যেমন, আইটিসি ইনফোটেক। নিজেদের ক্যাম্পাসের পাঁচিল তৈরির দায়িত্ব তারা নিজেদের ঘাড়ে রাখেনি। প্রায় ১৭ একর জমি ঘিরে পাঁচিল তোলার কাজ তারা তুলে দিয়েছে হিডকো’র হাতে। সংস্থা সূত্রের ব্যাখ্যা, হিডকো’কে জড়িয়ে রাখলে সিন্ডিকেটের থাবা কিছুটা এড়ানো যেতে পারে। অন্তত প্রাথমিক ধাক্কাটা হয়তো সামলানো যাবে।
যেখানে সিন্ডিকেটের নামে দুষ্কৃতীদলের দাপটে গৃহস্থ থেকে শিল্পের মুখে ত্রাহি রব, সেখানে প্রশাসন কী করছে?
কিছু যে করছে, তেমন ইঙ্গিত এখনও নেই। আগেও বিশেষ ছিল না। ২০১২-য় তোলাবাজিতে জেরবার হয়ে রাজারহাটের কয়েকটি আইটি সংস্থা রাজ্য সরকারের তথ্য-প্রযুক্তি দফতরে চিঠি দিয়ে সমস্যার কথা জানিয়েছিল। অভিযোগ করা হয়েছিল, সিন্ডিকেটের চাপে পড়ে চড়া দামে নিচু মানের ইমারতি দ্রব্য কিনতে তারা বাধ্য হচ্ছে, সঙ্গে সইতে হচ্ছে বিবিধ হুজ্জতি। চাকরির দাবি নিয়ে দুষ্কৃতীরা দল বেঁধে অফিসে ঢুকে পড়েছে। যাতায়াতের পথে কর্মীদের ভয় দেখানো হয়েছে। এমনকী, ডেবিট কার্ড কেড়ে নিয়ে জোর করে টাকা তোলানোও বাদ যায়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ওএনজিসি-ও ভুক্তভোগী। সিন্ডিকেটের জুলুমবাজি সেখানে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, রাজারহাটে ওএনজিসি’র ৩৩৯ কোটি টাকার প্রকল্পটির কাজ থমকে যায়। পরে প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপে বিবাদ মিটলেও প্রকল্প অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। এখনও তা সম্পূর্ণ হয়নি।
চিঠি-ই সার। প্রাথমিক ভাবে প্রশাসন সামান্য নড়েচড়ে বসলেও শেষমেশ কাজের কাজ কিছু হয়নি বলেই বিভিন্ন তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থার কর্তা-ব্যক্তিরা আক্ষেপ করেছেন। অন্য দিকে ভুরি ভুরি অভিযোগের উত্তরে পুলিশ-প্রশাসনের বক্তব্য, নির্দিষ্ট অভিযোগ না-পেলে তাদের পক্ষে কোনও পদক্ষেপ করা সম্ভব নয়। যা শুনে সংস্থা-কর্তারা বলছেন, “রোজ রোজ কি পুলিশ এসে আমাদের পাহারা দেবে? উল্টে পুলিশের কাছে গেলে সিন্ডিকেটের সঙ্গে রফা করা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।”
রাজারহাটে সিন্ডিকেটের প্রতাপের পিছনে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কথা বারবার বিভিন্ন মহলে শোনা গিয়েছে। রাজনীতির স্থানীয় কারবারিদের এখন কী মতামত?
সমস্যা যে রয়েছে, তা সরাসরি অস্বীকার করেননি স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত। তবে দায়টা তিনি চাপিয়েছেন পুলিশ-প্রশাসনের ঘাড়ে। “এটা প্রশাসনের দেখার কথা। আমি মন্তব্য করব না।” বলেছেন তিনি। এলাকার তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার ফোন তোলেননি। বিষয়টি জানিয়ে তাঁকে এসএমএস করা হয়েছিল। তারও জবাব আসেনি।