মমতার মতোই মঞ্চের ভাবনা সিপিএমে

রাজ্যে বিজেপি-র উত্থানে অশনি সঙ্কেত তারা দেখছিলই। তৃণমূলের পাশাপাশি বিজেপি-র বিপদের মোকাবিলায় এ বার স্রেফ দলীয় লড়াই থেকে বেরিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক মঞ্চ গড়ে এগোনোর ডাক দিল সিপিএম। লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে কোণঠাসা সিপিএমের পক্ষে এখন একক শক্তিতে তেমন জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তোলা কঠিন বুঝেই এমন মঞ্চ গড়ার কৌশল বলে দলেরই একটি সূত্রের ব্যাখ্যা।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৪ ০৩:৪৮
Share:

রাজ্যে বিজেপি-র উত্থানে অশনি সঙ্কেত তারা দেখছিলই। তৃণমূলের পাশাপাশি বিজেপি-র বিপদের মোকাবিলায় এ বার স্রেফ দলীয় লড়াই থেকে বেরিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক মঞ্চ গড়ে এগোনোর ডাক দিল সিপিএম। লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে কোণঠাসা সিপিএমের পক্ষে এখন একক শক্তিতে তেমন জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তোলা কঠিন বুঝেই এমন মঞ্চ গড়ার কৌশল বলে দলেরই একটি সূত্রের ব্যাখ্যা।

Advertisement

বিরোধী শিবিরে থাকাকালীন রাজ্যে তৃণমূল যখন মাত্র এক সাংসদ ও ৩০ জন বিধায়কের দল, তখন শাসক বামেদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের স্বার্থে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুরে ‘কৃষিজমি, জীবন ও জীবিকা বাঁচাও কমিটি’ এবং নন্দীগ্রামে ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’তে ছোট-মাঝারি নানা দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। ওই কমিটিই ছিল আন্দোলনের যৌথ মঞ্চ। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে সেই দলগুলির কেউই অবশ্য এখন আর তাদের সঙ্গে নেই। সিপিএম এমনিতেই বামফ্রন্ট চালিয়ে আসছে বহু দিন। কিন্তু এখন রাজ্যে দুই সাংসদ ও ৩৭ জন বিধায়কদের দল হিসাবে তারা শুধু বাম শরিকে সীমাবদ্ধ না থেকে আন্দোলনের জন্য বৃহত্তর মঞ্চ গড়তে চাইছে। যে উদ্যোগের সঙ্গে মমতার সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম কৌশলের মিল দেখছেন কেউ কেউ।

দলের রাজ্য কমিটির বৈঠকে শনিবার সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু যে রিপোর্ট পেশ করেছেন, সেখানেই বিজেপি-র বিপদকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যাকে তাঁদের শক্তির ‘স্বীকৃতি’ হিসাবেই দেখছেন এ রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্ব! সন্ত্রাস-কবলিত এলাকায় দ্রুত পৌঁছে গিয়ে বিজেপি যে ভাবে মানুষের মন পাওয়ার চেষ্টা করছে, তাকে বিপদের সঙ্কেত হিসাবে দেখেই নেতা-কর্মীদের স্থানীয় স্তরে সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বিমানবাবুর রিপোর্টে। এই কাজের জন্য এলাকায় এলাকায় উপযুক্ত নেতা-কর্মীদের চিহ্নিত করতেও বলা হয়েছে।

Advertisement

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দু’দিন আগেই বলেছেন, “রাজ্যে বিরোধী রাজনীতির জমি দখল নিতে চাইছে বিজেপি। জেলায় জেলায় আবার লাঠি ঘুরিয়ে নেমেছে আরএসএস!” দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের উপস্থিতিতে রাজ্য কমিটিতে বিমানবাবুর পেশ করা রিপোর্টও একই উদ্বেগের কথা বলছে। সেখানে বলা হয়েছে, সাধারণ ভাবে ‘বিভাজনের রাজনীতি’তে অভ্যস্ত বিজেপি এখন নিজেদের জনভিত্তি বাড়াতে খেটে-খাওয়া মানুষের সমর্থন পেতে চাইবে। রিপোর্টের ভাষায়, ‘সন্ত্রাস-কবলিত এলাকায় আক্রান্ত মানুষকে সহায়তা দেওয়ার নামে সে কাজ শুরু করে তারা কিছু সাফল্যও পেয়েছে। এখন এই ভূমিকাকে তারা বাড়াবে। আক্রান্ত ও বিপদগ্রস্ত মানুষেরও আপাতত নিরাপত্তার স্বার্থে দ্বিধার সঙ্গে হলেও সে পথে চালিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে’।

বস্তুত, তাঁদের আশঙ্কা যে অমূলক নয়, ভোটের পরে প্রতি সপ্তাহেই বিভিন্ন জেলায় (রবিবারই বর্ধমানের মঙ্গলকোটে হয়েছে) বাম কর্মী-সমর্থকদের বিজেপি-তে যোগদানের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এই ভাঙনের মোকাবিলায় একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কৌশল নিতে চাইছে আলিমুদ্দিন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার উপরে গুরুত্ব দিয়েই রাজ্য নেতৃত্বের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘রাজ্যে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এর জন্য সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে নিয়ে আলোচনা সাপেক্ষে বৃহত্তর ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক মঞ্চ গড়ে তোলার কাজে নামতে হবে’। দলের একাংশের মতে, এই ধরনের মঞ্চে দরজা খোলা থাকবে কংগ্রেসের জন্যও। প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের একাংশও মনে করেন, তৃণমূল এবং বিজেপি-র বিপরীতে বর্তমান পরিস্থিতিতে বামেদের সঙ্গে হাত মেলানোর কৌশল কার্যকরী হতে পারে। কংগ্রেসের অন্য অংশ আবার তৃণমূলের সঙ্গেই জোটে ফিরে যাওয়ার পক্ষপাতী!

বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ অবশ্য মনে করছেন, সিপিএমের এই মঞ্চ গড়ার ডাক বাস্তবে বিশেষ কাজ দেবে না। রাহুলবাবুর দাবি, “নিচু তলায় সিপিএম এখন একেবারে ধসে গিয়েছে! অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে তারা এমন ভাবছে হয়তো। কিন্তু মঞ্চ গড়তে চাইলেও তার নেতৃত্ব এখন স্থানীয় স্তরে সিপিএমের হাতে থাকবে না! কারণ, এক দিকে তাদের স্থানীয় নেতৃত্বই নেই। আবার যেখানে আছেন, সেখানে তাঁদের অনেককেই মানুষ আর বিশ্বাস করেন না!”

রাজনৈতিক ভাবে এই যৌথ মঞ্চ গড়তে চাওয়ার পাশাপাশিই সাংগঠনিক স্তরেও কিছু দাওয়াইয়ের কথা ভাবতে হচ্ছে আলিমুদ্দিনকে। এ বারের রিপোর্টেই যেমন বলা হয়েছে, ‘এ সবের মোকাবিলা করতে হলে সন্ত্রাস-কবলিত এলাকায় জেলা ও নির্দিষ্ট এলাকায় বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উপযোগী করে প্রয়োজনে পার্টি ও গণফ্রন্টগুলিকে পুনঃসংগঠিত করতে হবে’। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “স্থানীয় প্রশ্নে এলাকার বাস্তবতা বুঝে দ্রুত আন্দোলনের জন্য শুধু পার্টি দিয়ে হবে না। গণফ্রন্টকে নামতে হবে। গড়তে হবে প্রয়োজনভিত্তিক মঞ্চও।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement