১. সম্পত্তি: মুখ খুলতেই পুলিশ

মমতার পরিবার নিয়ে প্রশ্ন, তার পরেই তলব

দুপুরে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের সদস্যদের সম্পত্তি নিয়ে অভিযোগ করার জন্য সাংবাদিক বৈঠক করতে গিয়েই অনুমান করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ফের মামলা হতে পারে। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সিপিএম নেতা গৌতম দেবকে একটি পুরনো মামলার সূত্রে ডেকে পাঠাল বিধাননগরের ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানার পুলিশ। আজ, বুধবার তাঁর থানায় হাজিরা দেওয়ার কথা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৫৯
Share:

রাতে সল্টলেকের বাড়িতে পুলিশের কাছ থেকে হাজিরার নোটিস নিচ্ছেন গৌতম দেব। মঙ্গলবার। ছবি: শৌভিক দে

দুপুরে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের সদস্যদের সম্পত্তি নিয়ে অভিযোগ করার জন্য সাংবাদিক বৈঠক করতে গিয়েই অনুমান করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ফের মামলা হতে পারে। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সিপিএম নেতা গৌতম দেবকে একটি পুরনো মামলার সূত্রে ডেকে পাঠাল বিধাননগরের ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানার পুলিশ। আজ, বুধবার তাঁর থানায় হাজিরা দেওয়ার কথা।

Advertisement

আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সাংবাদিক বৈঠক শেষ করে রাজ্যের প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেব গিয়েছিলেন নদিয়ায় নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা করতে। গৌতমবাবুর অনুপস্থিতিতেই রাতে দু’দুবার তাঁর বাড়িতে একটি বাদামি রঙের খাম নিয়ে যায় পুলিশ। গৌতমবাবুর স্ত্রী দেবযানীদেবী সেই চিঠি গ্রহণ করতে চাননি। রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ গৌতমবাবু বাড়িতে ঢোকেন। তার ১০ মিনিটের মধ্যেই বিধাননগর (দক্ষিণ) থানার ওসি তাঁর বাড়িতে এসে গৌতমবাবুকে একটি নোটিস ধরিয়ে দেন। সেখানে বলা হয়েছে, আজ, বুধবার বেলা দুটোয় ইলেকট্রনিক্স থানায় গিয়ে আইসি পি রায়ের সঙ্গে দেখা করতে হবে গৌতমবাবুকে।

কেন? নোটিসে বলা হয়েছে, বিধাননগর (উত্তর) থানার একটি জালিয়াতির মামলার (কেস নম্বর ১০২, তারিখ ৬ মে, ২০১৩) তদন্ত নিয়ে গৌতমবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, মামলাটি সারদা সংক্রান্ত। মামলাটি করেছিলেন মল্লিকা চট্টোপাধ্যায় নামে এক আমানতকারী। নরোত্তম দত্ত নামে সারদার এক এজেন্টের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছিল। সেই মামলায় সুদীপ্ত সেন-সহ একাধিক ব্যক্তির নামে অভিযোগ দায়ের করা হয়। এই মামলাতেই হিডকোর প্রাক্তন জনসংযোগ আধিকারিক অঞ্জন ভট্টাচার্যকেও জিজ্ঞসাবাদ করে পুলিশ। সেই সূত্রেই গৌতমবাবুকে ডাকা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। গৌতমবাবু কি থানায় হাজিরা দিতে যাবেন? প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া, “নিশীথদা (প্রাক্তন আইনমন্ত্রী নিশীথ অধিকারী)-র সঙ্গে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নেব।” গৌতমবাবুকে পুলিশের ডেকে পাঠানো প্রসঙ্গে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে বলা হয়েছে, তাঁদের কিছু বলার নেই। আইন আইনের পথে চলবে।

Advertisement

বস্তুত সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে রাজ্য ছাড়িয়ে এমনকী জাতীয় স্তরেও শোরগোলের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের অল্প সময়ে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হওয়া নিয়ে এ দিন প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গৌতম দেব। তিন বছর আগে বিধানসভা ভোটের আগে কুপন কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে বিপুল দামে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি বিক্রি— সাম্প্রতিক কালে তৃণমূল নেত্রীকে একের পর এক চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন তিনি।

এ দিন আলিমুদ্দিনে সাংবাদিকদের সামনে একের পর এক জমির দলিল তুলে ধরে প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী দেখানোর চেষ্টা করেন, কালীঘাটে তৃণমূল নেত্রীর পাড়ায় বহু সম্পত্তি কী ভাবে তাঁরই ভাই এবং ভ্রাতৃবধূদের হাতে এসেছে।

মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের বিরুদ্ধে বেআইনি কাজকর্মের অভিযোগ অবশ্য আনেননি গৌতমবাবু। তাঁর বক্তব্য দু’টি। প্রথমত, বারেবারে স্বচ্ছতার আদর্শ মেনে চলার কথা বলতে অভ্যস্ত মুখ্যমন্ত্রী তাঁর পরিবারের লোকজনের উপরে কোনও নজরদারি রেখেছেন কি না? এবং দ্বিতীয়ত, তাঁর পরিবারের হাতে এই বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কেনার রসদ কী ভাবে এল?

গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে দু’টি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর নিকটজনের আর্থিক সঙ্গতি এবং সম্পত্তি আগে কত ছিল আর এখন কত হয়েছে, তা খোঁজ নিতে বলেছিলেন। যে মন্তব্যের জন্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছিল তৃণমূল। গৌতমবাবুও এ দিন বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে আবার মামলা হতে পারে, ধরে নিয়েই তিনি এই সব নথি সামনে আনছেন। এ দিন রাতে তিনি বলেন, “আমি যা কাগজ দিয়েছি, তা যদি ভুল হয়, তা হলে আমার বিরুদ্ধে কেস করুক, আমায় জেলে পাঠাক।”

ভোটের মাঝে গৌতমবাবুর এমন বক্তব্যে স্বভাবতই প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছে তৃণমূল শিবিরে। তৃণমূল নেত্রীর এক ভাই সমীর (কার্তিক) বন্দ্যোপাধ্যায় পাল্টা বলেছেন, তাঁর দিদির বদনাম করার জন্যই গৌতমবাবু এ সব কথা বলছেন! আর পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম সিপিএমের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার অভিযোগ এনেছেন। সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে গৌতমবাবুর যোগসাজশের অভিযোগও টেনেছেন। কিন্তু ঠিক কী ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার সমৃদ্ধিশালী হয়েছে, তার নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা কেউই দেননি।

৩০বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের (কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাসস্থান) ঠিকানার বিভিন্ন ব্যক্তির নামে একাধিক জমি-সম্পত্তির মালিকানা সংক্রান্ত নথি এ দিন জনসমক্ষে এনেছেন গৌতমবাবু। সম্পত্তির এই মালিকানা যাঁদের হাতে, ঘটনাচক্রে তাঁরা সকলেই মুখ্যমন্ত্রীর ভাই এবং ভ্রাতৃবধূ। অন্তত ১৫টি দলিল, জমির দানস্বত্ব দেওয়া দলিল এবং অন্যান্য নথি এ দিন পেশ করেছেন প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী। এসি এবং নন-এসি ঘর সম্বলিত পুরীর একটি হোটেলের কথাও এসেছে। যে সব নথি দেখানো হয়েছে, প্রাথমিক ভাবে তার হিসেবে সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২০ কোটি টাকা। প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রীর দাবি, “হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের প্রায় ৭৫% একটা পরিবারই কিনে নিয়েছে। যা দেখাতে পারছি, সেটা হিমশৈলের চূড়া মাত্র! বরফের ৯ ভাগ এখনও জলের তলায়!”

একেবারে নিজস্ব কায়দায় মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে গৌতমবাবুর মন্তব্য, “উনি হাওয়াই স্যান্ডেল পরে ঘোরেন, হেলিকপ্টারে চড়েন। বিমান ভাড়া নেন। হেলিকপ্টার কেন কম পড়ল, তার জন্য দুঃখও করেন!” তার জন্যই কি মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারকে আক্রমণ? গৌতমবাবুর বক্তব্য, “এ সব আমাদের কাজ না। কিন্তু উনি রোজ সততার কথা বলবেন, অন্যকে গাল দেবেন, ক্লাবকে, একে-তাকে টাকা দেবেন, যা খুশি তা-ই করবেন, এ সবের তো একটা সীমা আছে! এক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (মুখ্যমন্ত্রী) যে পরিবারে থাকেন, সেই পরিবারের লোকজন কী ভাবে সম্পত্তি কিনেই চলেছেন, তার একটা অংশ জানাচ্ছি মাত্র! দলিল নম্বর ধরে যে কেউ খোঁজ করতে পারেন!”

আইনত এই জমি বা সম্পত্তি কেনায় তো কোনও বাধা নেই?

প্রাক্তন মন্ত্রীর বক্তব্য, “না, নেই। কিন্তু তা হলে বলতে হবে, অমুক অমুক সূত্রে আয় থেকে এই সম্পত্তি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জবাব চেয়ে অবশ্য কোনও লাভ নেই!”

দুপুরে আলিমুদ্দিনে বসে গৌতমবাবু মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের ঘনিষ্ঠদের সম্পত্তি কেনার হিসেব দাখিল করার পরে বিকেলেই তৃণমূল ভবনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। গৌতমবাবুকে ‘পাগল ও জঘন্য ব্যক্তি’ আখ্যা দিয়ে পুরমন্ত্রী বলেন, “মমতাদি’র ভাইদের সঙ্গে তাঁর বাড়ির বৌদেরও টেনে আনা হয়েছে। ধিক, ধিক, ধিক!”

এই সূত্রেই হিডকো-র প্রাক্তন জনসংযোগ আধিকারিক অঞ্জন ভট্টাচার্যের প্রসঙ্গ টেনে সারদা-কর্তার সঙ্গে প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রীর নাম জড়ানোর চেষ্টা করেছেন পুরমন্ত্রী। তিনি অভিযোগ করেন, সারদা মালিক সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে গৌতমবাবুর সম্পর্ক ছিল। হিডকোর প্রাক্তন জনসংযোগ আধিকারিক অঞ্জন ভট্টাচার্যের প্রসঙ্গ টেনে ববি বলেন, “তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সিআরপিসি-র ১৬৪ ধারা অনুসারে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, গৌতমবাবুই প্রথম তাঁর সঙ্গে সুদীপ্ত সেনের আলাপ করিয়ে দেন।’’ এমনকী, সুদীপ্ত সেনের থেকে সাদা খাম আসত গৌতমবাবুর কাছে। সেই খামে ‘প্রেমপত্র’ থাকত কিনা সেই প্রশ্ন তুলে ববি বলেন, “চিটফান্ড মালিক আবাসনমন্ত্রীকে খাম পাঠাচ্ছেন। সেটার মানে কী হয় আপনারাই বিচার করুন।”

মুখ্যমন্ত্রীর যে সব ভাই ও ভ্রাতৃবধূদের নাম গৌতমবাবু বলেছেন, তাঁদের মধ্যে সমীরও (কার্তিক) আছেন। তাঁর জবাব, “গৌতম দেব আরও বেশি সম্পত্তির হিসেব দিলে আমরা খুশি হতাম! উনি দিদির বদনাম করতে গিয়ে আমাদের না হয় আরও একটু বেশি দিতেন! সব চেয়ে ভাল হতো, দলিলগুলো পাইয়ে দিলে।” অফিস থেকে ঋণ নিয়ে কালীঘাটে তিনি ৭৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে সমীরবাবুর দাবি। এ ছাড়া, কালীঘাট রোডে নিলামে চার কাঠা জমিও কিনেছেন বলে দাবি করেছেন তিনি।

এ দিন রাতে পুলিশের দেওয়া নোটিস পড়ে গৌতমবাবুর প্রতিক্রিয়া, “পাগলের রাজত্বে আর কী হবে! পুলিশকে বলছি, আমাকে ডেকেছেন, মমতাকেও ডাকুন। পাঁচ বছরে আমার আর মমতার কল লিস্ট খুঁজে বের করুন। মমতার সঙ্গে সুদীপ্ত সেনের কোনও কথা হয়েছে কি না, তা জানা যাবে। আমিও সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে কথা বলেছি কি না, পরিষ্কার হবে।”

প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রীর কটাক্ষ, “আসলে দিদির আবদার, গৌতমকে এক রাতের জন্য লক-আপে রাখ! আমাকে জড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তা করে উনি কি বাঁচবেন? বাঁচা কি এত সোজা!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement