বছর কুড়ি আগের সেই ফৌজদারি মামলাটি এখনও তামাদি হয়নি। ৬ জুন তার শুনানি বারাসত আদালতে।
সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মঙ্গলবার রাতে তাঁর সল্টলেকের বাড়িতে পুলিশ পৌঁছনোর পরে ২০ বছর আগের সেই মামলার প্রসঙ্গই টেনে আনেন প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিপিএম নেতা গৌতম দেব। একটি ইংরেজি দৈনিকের পুরনো খবরের কাটিং দেখিয়ে গৌতমবাবুর অভিযোগ, “১৯৯৪ সালে বারাসতে যুব কংগ্রেসের এক সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধানো ও সরকারি সম্পত্তি নষ্টের অভিযোগ উঠেছিল।” সিপিএম নেতা জানান, বারাসত আদালতের বিচারক সিদ্ধার্থ রায়চৌধুরী বার বার বলা সত্ত্বেও মমতা আদালতে হাজির হননি। প্রায় ১২ বছর ধরে এই অবস্থা চলার পর পুলিশও তাঁকে হাজির করছে না দেখে ক্ষুব্ধ বিচারক ২০০৬ সালের গোড়ার দিকে মন্তব্য করেন, পুলিশ আদালতের নির্দেশ এড়িয়ে যাচ্ছে। এর পরেই তৎকালীন যুব কংগ্রেস নেত্রীর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। তাতে বলা হয়, ২৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে (২০০৬ সাল) পরোয়ানা কার্যকর করতে হবে। কিন্তু ৮ বছর ধরে সেই পরোয়ানা কার্যকর করেনি পুলিশ।
পুরনো সেই পরোয়ানা মুখ্যমন্ত্রী এড়িয়ে গিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলে গৌতমবাবু মন্তব্য করেন, “আমার বাড়িতে পুলিশ পাঠাচ্ছে! ওর (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) নামেও তো গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। তার কী হল?” আদালত সূত্রে খবর, দু’দশক আগে বারাসতের সেই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে এখনও রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম।
এই ঘটনা যখনকার, তখন রাজ্যে বাম সরকার। মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশ মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অভিযুক্ত যুব কংগ্রেস নেত্রী তখন তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী ও সাংসদ। গৌতমবাবুকে প্রশ্ন করা হয়, আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও কেন আপনারা তাঁকে গ্রেফতার করেননি? গৌতমবাবুর ব্যাখ্যা, “ওই সময়ে মমতাকে গ্রেফতার করলে রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই তাঁকে গ্রেফতার না করে আদালতে আত্মসমর্পণের সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, মমতা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকা অবস্থাতেই ফের সেই বারাসত আদালতের কাছে, পুলিশের সামনেই সভা করেন।”
তবে পরিস্থিতি যাই হোক, সেই সময় মমতাকে গ্রেফতার করাই উচিত ছিল বলে মনে করেন গৌতমবাবু। তাঁর স্পষ্ট কথা, “গ্রেফতার করা তো উচিত ছিল। আমি পুলিশমন্ত্রী থাকলে নিশ্চয় গ্রেফতার করতাম।” তাঁর কথায়, “আমি জানতামই না যে ওঁর (মমতা) নামে পরোয়ানা রয়েছে। মাস খানেক আগে খবর পেয়ে বারাসত আদালতে খোঁজ নিলাম। দেখলাম সত্যি তো! ভাবুন!” তাঁর মন্তব্য, “২০১১ সালে বিধানসভা ভোটে প্রার্থী হতে যে ফর্ম পূরণ করতে হয়, সেখানে কী তিনি লিখেছিলেন যে তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে!” এই বক্তব্য নিয়ে বুদ্ধবাবুর সঙ্গে কথা বলার জন্য বার বার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি।
সে দিন বারাসতে কী হয়েছিল? আদালত ও জেলা পুলিশ সূত্রে খবর, ৯৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভা ছিল। সভা চলাকালীন পুলিশের সঙ্গে যুব কংগ্রেস কর্মীদের গণ্ডগোল বাধে। পুলিশের গুলিতে মারা যান যুব কংগ্রেস কর্মী গোবিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। জেলার পুলিশ সুপার তখন রচপাল সিংহ (বর্তমানে মমতা সরকারের সমবায় মন্ত্রী)।
জনতাকে উত্তেজিত করে পুলিশের উপরে হামলা চালানো ও অন্যান্য ধারায় মমতার বিরুদ্ধে বারাসত থানায় মামলা (নম্বর ১২৪, ২২/২/৯৪) করে পুলিশ। মামলার অন্যতম আইনজীবী অরুণ দেবনাথ এ দিন বলেন, “ওই মামলায় ১৯৩ জন অভিযুক্ত ছিলেন। তার মধ্যে ১৮৩ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। পরে তাদের জামিন হয়ে যায়। বাকি দশ জনের মধ্যে তিন জন আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। বাকি সাত জনের কেউই আগাম জামিন নেননি। তাঁদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। এই সাত জনের মধ্যেই রয়েছেন সৌগত রায় (এখন সাংসদ) ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।”
অন্যতম আসামি সৌগত রায় বলেন, “১৯৯৪ সালের পর ১৭টা বছর রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ছিল। তখন গ্রেফতার করেনি কেন? আমরা গণ-আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। গ্রেফতার হলে গর্বিত হতাম।” এর পর তিনি বলেন, “৩১ হাজার ভোটে হারার পর গৌতমবাবু মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন।” আইনজীবী অরুণবাবুর কথায়, যে হেতু পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও মমতা-সহ সাত জনকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি, তাই অনির্দিষ্ট কাল মামলাটি চলবে। তিনি জানান, ফৌজদারি মামলা কখনও তামাদি হয় না। মামলার শেষ শুনানি ছিল ২০১৩-র ২৮ নভেম্বর। মামলার পরবর্তী দিন ঠিক হয়েছে ৬ জুন।