মতুয়া ভক্তদের সঙ্গে আলোচনা সেরে বেরোচ্ছেন মমতাবালা ঠাকুর। —নিজস্ব চিত্র।
চব্বিশ ঘণ্টা আগেই তৃণমূল ছেড়ে বড় ছেলেকে নিয়ে দলত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর। এ বার সেই ছেলের সঙ্গেই তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই বলে শুক্রবার নিজের বাড়িতে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়ে দিলেন সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা তথা মঞ্জুলের মা বীণাপাণিদেবী (বড়মা)।
নির্বাচনের আগে তৃণমূলের মন্ত্রীকে নিজেদের দলে নিয়ে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব যে ধাক্কা শাসক দলকে দিয়েছিল, এ দিন বড়মার ওই ঘোষণার পরে তৃণমূল শিবির ফের উজ্জ্বীবিত। জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব মনে করছেন, পাল্টা ধাক্কা বিজেপি শিবিরে পৌঁছে দেওয়া গিয়েছে। তৃণমূল নেতৃত্বের উল্লসিত হওয়ার অবশ্য যথেষ্ট কারণও আছে। কারণ, মতুয়া ভক্তদের মধ্যে এখনও সব থেকে বেশি প্রভাব যদি কারও থেকে থাকে, তবে তিনি বড়মা। মতুয়া ভক্তদের কাছে বড়মার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। সেই বড়মাই কঠিন সময়ে দলের পাশে দাঁড়ানোয় জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। দলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “বড়মা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিজের মেয়ের মতো দেখেন। নেত্রী সব সময়ে ঠাকুরবাড়ির উন্নয়নে তাঁর পাশে থেকেছেন। এ দিনও মুখ্যমন্ত্রী বড়মার জন্য এক জন চিকিৎসক ও এক জন নার্স ঠাকুরবাড়িতে পাঠিয়েছেন। বড়মার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।”
শুক্রবার সকালে মতুয়াদের পীঠস্থান গাইঘাটার ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়িতে নিজের ঘরের বারান্দায় বড় বৌমা মমতাবালা ঠাকুরকে সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন বড়মা। সূত্রের খবর, ওই সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজক ছিলেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারাই। বৃহস্পতিবার রাতেই ওই সাংবাদিক আয়োজনের তোড়জোর শুরু হয়। এ দিন সকালে বড়মার ওই সাংবাদিক সম্মেলনের সময় পাশে ছিলেন গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ধ্যানেশনারায়ণ গুহ, বনগাঁ দক্ষিন কেন্দ্রের বিধায়ক সুরজিৎ বিশ্বাস, জেলা নেতা অজিত সাহা, রাজীব দত্তরা। সাংবাদিক সম্মেলনের জন্য মাইক আনা হয়েছিল। বড়মা হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে কথা বলেন। অতীতে তাঁকে মাইক্রোফোন হাতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়নি। বনগাঁ কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী মমতাবালা তাঁকে ধরে ঘর থেকে বারান্দায় নিজে আসেন। ভোট যুদ্ধে নামার আগে বড়মা তাঁকে মাথায় হাত রেখে আর্শীবাদ করেন। ছোট ছেলে ও নাতি বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, সে বিষয়ে মতামত জানাতে চাওয়ায় বড়মা বলেন, “ওর সঙ্গে (মঞ্জুল) আমার কোনও সম্পর্ক নেই।” বড়মা ওই ঘোষণা করতেই উপস্থিত তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা হাততালি দিয়ে ওঠেন। বড়মা বলে চলেন, “ওর (মঞ্জুল) ক্ষমতা আছে, তাই বিজেপিতে ঢুকতেই পারে। আমি কী করতে পারি?”
মঞ্জুল বা তাঁর বড় ছেলে অবশ্য বড়মার ওই ঘোষনাকে তেমন আমল দিচ্ছেন না। নিজের বাড়িতে বসে মঞ্জুল এ দিন বলেন, “মায়ের ৯৬ বছর বয়স হল। শরীর ঠিক থাকলেও ব্রেনটা ঠিক থাকে না। সেন্সটা কিছু সময় থাকে, আবার চলে যায়। ৭-৮ বার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এই বয়সে ব্রেন আর স্বাভাবিক হবে না।” তাঁর দাবি, “ভোটের আগে নিজেদের স্বার্থে তৃণমূলের লোকেরা মাকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলিয়ে নিচ্ছেন। উনি সকলের বড়মা। তিনি আমারও মা। পৃথিবীতে কোনও দিন হয় নাকি, মায়ের সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক থাকে না! তিনি মাথার উপরে আছেন। সত্যের বিচারে ওই চক্রান্ত টিঁকবে না।” সুব্রতর বক্তব্য, “বড়মা পাঁচ মিনিট আগে কী বলেন, পাঁচ মিনিট পরে তা ভুলে যান। উনি ওই সব বলেননি। ওঁকে পাশ থেকে তৃণমূলের লোকেরা ওই সব বলিয়ে নিয়েছেন।” তাঁর সংযোজন, “দু’টো দিন অপেক্ষা করুন। তা হলেই দেখতে পাবেন, সুব্রত ঠাকুরের সঙ্গে কারা আছেন। বাঁধটা ভাঙতে দিন। ওদের ওখানে মাছিও উড়বে না।”
মতুয়াবাড়ির একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানাচ্ছে, এটা ঠিক যে বড়মা এখন ঠিকমতো হিসেব করে কথা বলতে পারেন না। এ দিন তৃণমূল নেতারা তাঁকে বক্তব্য পরিবেশনে সহযোগিতা করেছেন। সেটা অবশ্য নতুন কোনও ঘটনা নয়। তবে ওই বিষয়টি তিনি নিজেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সরাসরি জানিয়েছেন। বড়মা এ দিন মতুয়া ভক্তদের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, “ওর (মমতাবালা) অল্প বয়সে কপাল পুড়ে গিয়েছে। দুঃখের জীবন তার। এখন ওর তো কিছুই নেই। আমি ভক্তদের বলছি, তাকে জয়ী করুন।”
যা শুনে মমতাদেবী বলেন, “বড়মার আশীর্বাদ আমার কাছে পৃথিবীর সব থেকে মূল্যবান জিনিস। বড় ঠাকুর (কপিলকৃষ্ণ) আজ নেই। এই আনন্দের মধ্যেও ব্যথা রয়েছে। দিদি (মুখ্যমন্ত্রী) আমাকে মনে করেছেন বলে আমি ধন্য। ঠাকুরের ভক্তেরাও আমার পাশে রয়েছেন।”
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রার্থী হিসাবে তৃণমূলের তরফে মমতাদেবীর নাম ঘোষণার পরে তিনি জানিয়েছিলেন, মতুয়া ভক্তদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবেন। এ দিন সকালে ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, মমতাদেবী মতুয়া ভক্তদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। পরে তিনি বলেন, “ফোনে বা সরাসরি মতুয়া ভক্ত-গোঁসাই-পাগলদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তাঁরা ভোটে দাঁড়ানোর অনুমতি দিয়েছেন। আর্শীবাদ দিয়েছেন। আমাকে জয়ী করতে ঝাঁপাবেন বলেও জানিয়েছেন।” তাঁর বিরুদ্ধে আনা মঞ্জুলের অভিযোগের বিষয়ে মমতাবালা বলেন, “যার যেমন চরিত্র, সে তো তেমনই বলবে। আমার স্বামীর মৃত্যু স্বাভাবিক ঘটনা।” যা শুনে মঞ্জুলের প্রতিক্রিয়া, “উনি স্বামীর মৃত্যু নিয়ে সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করছেন মানেই ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। আজ, নয় তো পঞ্চাশ বছর পরে দাদার মৃত্যুর সিবিআই তদন্ত হবেই।”