মাছ-হারা নদী থেকে মুখ ফিরিয়েছেন ওঁরা।
বাড়ির উঠোনে স্তূপীকৃত নাইলনের জাল, নদী-বাওরের কিনারে শুকিয়ে কাঠ নৌকার পাটাতন।
ভরা ভাদ্রে জেলে পাড়ার উঠোনে এখন শুধুই হা হুতাশ, ‘মা গঙ্গা মুখ ফেরাইছেন গো’! ক্যানিং, ডায়মন্ড হারবার কিংবা রায়দিঘি, হলদিয়া লাগোয়া মৎস্যজীবীদের গ্রামগুলির উপরে এমনই হতাশার ছায়া।
রুজির টানে তাঁদের অনেকেই এখন পাড়ি দিচ্ছেন ওড়িশা, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ। তবে জাল-নৌকা-ট্রলারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে নয়। ‘পেট ভরাতে’, কেউ জোগাড়ে কেউ বা ছোট কল-কারখানায় মাস মাইনের চাকরির খোঁজে। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন মৎস্যজীবী সংগঠনের এমনই দাবি।
অথচ বছর কয়েক আগেও ছবিটা এমন ছিল না। কাকদ্বীপ বন্দরের কোলে অলস ট্রলারের ভিড়টা দেখিয়ে সদানন্দ মণ্ডল বলছেন, “বছর দুয়েক ধরেই নদী-মোহনা প্রায় খালি হাতেই ফিরিয়ে দিচ্ছে আমাদের। এ বার মাছের আকালটা একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছে। সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে।” সদানন্দের মতো অনেকেই গভীর সুদ্রে মাছ ধরেতে গিয়ে ‘খালি হাতে’ ফিরে এসেছেন। হলদিয়ার সুখেন হালদারের অভিজ্ঞতা, “দিন পনেরোর রসদ নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলাম মোহনায়। মাছের বদলে জলে ভেসে মুখ পুড়িয়ে ঘরে ফিরে সংসার টানা আর সম্ভব হচ্ছে না।” সুখেন তাই কেরল পাড়ি দেওয়া মনস্থ করেছেন। বলছেন, “পাঁচ ছেলেমেয়ে, বউসাত জনের সংসারটা তো না-খেতে পেয়ে মরতে বসেছে। তাই কেরলে একটা নৌকা তৈরির কারখানায় যোগ দিচ্ছি।”
সদানন্দ বা সুখেন কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। মৎস্যজীবীদের সংগঠন ইউনাইটেড ফিশারমেন অ্যাসোসিয়েশন -এর সভাপতি জয়কৃষ্ণ হালদােরের কথাতেই তা স্পষ্ট--“নদী-মোহনায় মাছের দিন শেষ। রুজির টানে মৎস্যজীবীরা অন্য রাজ্যে পাড়ি দিলে তাঁদের রুখব কী করে!” তাঁদের সংগঠনের পরিসংখ্যান বলছে, রায়দিঘি, কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবার এলাকায় সংগঠনের প্রায় ৪০ শতাংশ সদস্য এখন অন্য পেশায়। তিনি জানান, গভীর সমুদ্রে যাঁরা মাছ ধরতে যান তাঁদের অধিকাংশেরই নিজের ট্রলার নেই। ডায়মন্ড হারবারের ইসমাইল সেখ বলেন, “তা থাকার কথাও নয়। ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকার ট্রলার তাঁরা কিনবেন কী করে?”
জয়কৃষ্ণ জানান, অধিকাংশ মৎস্যজীবীই ‘ভাগের ট্রলারের’ উপরে নির্ভর করেন। অর্থাৎ, দু-তিন সপ্তাহের জন্য ট্রলার ভাড়া নেন তাঁরা। চাল-ডাল-জল, রসদ নিয়ে ভেসে পড়েন তাঁরা। সঙ্গে রয়েছে ট্রলারের জ্বালানির খরচ। সব মিলিয়ে ট্রলার মালিকের সঙ্গে চুক্তি হয় ৬০/৪০ হিসেবে। ভেঙে বললে, যে পরিমাণ মাছ উঠবে তার চল্লিশ ভাগ পাবেন ট্রলার মালিক। বাকিটা ভাগ করে নেবেন মৎস্যজীবীরা। এক একটি ট্রলারে জনা পনেরো মৎস্যজীবী থাকেন। ওই টাকা তাঁদের মধ্যে ভাগ হওয়ার কথা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে মাছের আকাল দেখা দেওয়ায় তাঁদের অনেকেই ট্রলার মালিকের পাওনাই মেটাতে পারছেন না। মাছের আশায় বসে না থেকে তাই ওই সংগঠনের অন্তত ৪০ শতাংশ সদস্যই এ বার পাড়ি দিয়েছেন অন্যত্র। এমনই দাবি জয়কৃষ্ণের। তিনি জানান, সাড়ে সাত হাজার সদস্যের চল্লিশ শতাংশই আজ রুজির টানে অন্যত্র।
মোহনা থেকে মাছ হারাল কেন?
উত্তরটা দিচ্ছে দেশের মৎস্য সংরক্ষণে সর্বোচ্চ সংস্থা ফিশারিজ সার্ভে অফ ইন্ডিয়া। তাদের রিপোর্ট বলছে, দূষণ দীর্ণ গঙ্গা থেকে শুধু ইলিশের মতো পরিযায়ী মাছই নয়, গঙ্গা মোহনা থেকে মুখ ফিরিয়েছে অন্য মাছও। বিশেষজ্ঞদের দাবি, দূষণের পাশাপাশি বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় মোহনায় জলের মিষ্টতা হ্রাস পেয়েছে। মাছ কমে যাওয়ার তা-ও একটা বড় কারণ। গঙ্গা দূষণ প্রতিরোধ কমিটির সদস্য পরিবেশবিদ সুভাষ দত্তের অভিজ্ঞতা, “কলকাতার টালি নালা এবং হাওড়ার নাজিরগঞ্জ খাল বাহিত বর্জ্যই গঙ্গা বিষিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। সঙ্গে রয়েছে কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক বাহিত জল, পুর-আবর্জনা। গঙ্গা এখন নীলকণ্ঠ।”
সেই বিষাক্ত ‘নীল’ মোহনায় কি মাছ থাকে?