মুখে নেত্রীর নাম, তবু বিজেপি এড়ালেন মুকুল

এক দিনের মধ্যেই আবার ভোল বদলে ফেললেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়! বনগাঁ লোকসভা উপনির্বাচনের প্রচারে এসে শনিবার ঠাকুরনগরের সভায় তৃণমূল নেত্রীর নাম মুখে এনেছিলেন মাত্র বার দু’য়েক। রবিবার সেই একই লোকসভা এলাকার গোবরডাঙায় মুকুল তাঁর দলনেত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ! সারদা-কাণ্ডে ‘মানুষের রায়ে’র উপরেই ভরসা রেখেছেন মুকুল। তবে ৩০ মিনিটের ভাষণে একটি বারও বিজেপি-র সমালোচনা শোনা যায়নি তাঁর মুখে।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

গোবরডাঙা  শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৩
Share:

গোবরডাঙায় দলের এক অনুরাগীর সঙ্গে খোসমেজাজে মুকুল রায়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

এক দিনের মধ্যেই আবার ভোল বদলে ফেললেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়! বনগাঁ লোকসভা উপনির্বাচনের প্রচারে এসে শনিবার ঠাকুরনগরের সভায় তৃণমূল নেত্রীর নাম মুখে এনেছিলেন মাত্র বার দু’য়েক। রবিবার সেই একই লোকসভা এলাকার গোবরডাঙায় মুকুল তাঁর দলনেত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ!

Advertisement

সারদা-কাণ্ডে ‘মানুষের রায়ে’র উপরেই ভরসা রেখেছেন মুকুল। তবে ৩০ মিনিটের ভাষণে একটি বারও বিজেপি-র সমালোচনা শোনা যায়নি তাঁর মুখে। ফলে নিজে খোশমেজাজে থাকলেও তাঁকে নিয়ে দলের উদ্বেগ থামছে না।

মুকুল এ দিন বলেন, “বাংলায় একটা নতুন জিনিস হয়েছে। সারদা-সারদা করে আলোচনা চলছে! মনে রাখতে হবে, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোট এবং ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটেও এই বিষয়টি সামনে ছিল। কিন্তু মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছেন। তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, সারদা নিয়ে যে অপপ্রচার চলছে, তা তাঁরা মানেন না।” এর পরেই তাঁর দাবি, “আমি ব্যক্তিগত ভাবে বা দলের কাস্টডিয়ান (দায়িত্বপ্রাপ্ত) হিসাবে বলছি, আমি বা আমাদের দল সারদায় কোনও ভাবে যুক্ত নয়। ভবিষ্যতের ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেবে।” গোটা ঘটনাপ্রবাহ দেখে তৃণমূলের এক বর্ষীয়ান নেতার মন্তব্য, “মুকুলের আসলে উভয় সঙ্কট যাচ্ছে! উপনির্বাচনে হারলে এমনিতেই ধাক্কা খাবে বিজেপি। তার মধ্যে দলনেত্রীর সঙ্গে বেশি দূরত্ব করে ফেললে কোনও দিকেই যাওয়ার থাকবে না! মুকুল তাই কূটনীতি চালাচ্ছে!”

Advertisement

দলের ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এ দিনই প্রচারে গিয়ে বিজেপি প্রার্থী সুব্রত ঠাকুরকে তুলোধোনা করেছেন। গোপালনগরের সভায় দলনেত্রীর প্রশংসা করে অভিষেক বলেন, “মমতার আদর্শ, ত্যাগ, মানসিকতা, দৃঢ়তায় উৎসর্গীকৃত হয়ে যিনি মানুষের পাশে দিনরাত্রি দাঁড়িয়ে আন্দোলনে নামার প্রতিশ্রুতি নেবেন, তিনিই এই দলে আসবেন।” এই প্রসঙ্গেই বিজেপি-র প্রতি তাঁর কটাক্ষ, “ফোন হাতে নিয়ে মিসড্ কল দিয়ে এ দলে সদস্য হওয়া যায় না!” ওই সভাতেই সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় আবার কড়া সুরে বলেছেন, “বিজেপি দলটা ভেন্টিলেশনে চলে গিয়েছে! সিবিআই প্রতারিত মানুষের টাকা ফেরত দেওয়ার কোনও নামই করছে না। অথচ সেই জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক কোটি টাকার তহবিল গড়েছেন। কমিশন বসিয়েছেন।” তাঁর আরও বক্তব্য, “প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরা।” মুকুল অবশ্য সিবিআই-বিজেপি প্রসঙ্গে এমন কড়া বার্তা দেওয়ার পথে হাঁটেনননি।


বনগাঁয় তৃণমূলের প্রচারে ইন্দ্রনীল সেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: শান্তনু হালদার

শাসক দলে এমন টানাপড়েন দেখেই চাপ বাড়াতে সক্রিয় রয়েছে বিরোধী বামেরা। বনগাঁর বাম প্রার্থী দেবেশ দাসের সমর্থনে নির্বাচনী সভায় এ দিনই সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব দাবি করেছেন, “তৃণমূলের এক মন্ত্রী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। মমতার জায়গায় তিনিই মুখ্যমন্ত্রী হতে চাইছেন!” গৌতমবাবুর দাবি, মমতা মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ ওই মন্ত্রী যোগাযোগ করে বলেছেন, ৪৫ জন বিধায়ককে নিয়ে তিনি দল ছাড়তে প্রস্তুত। বামফ্রন্ট যেন তাঁকে সমর্থন করে। আবার মেদিনীপুরে দলের জেলা সম্মেলনের সমাবেশে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কটাক্ষ, “উনি (মমতা) বললেন, ‘একটা মুকুল ঝরলে আমাদের কিছু যায় না। আমাদের লক্ষ লক্ষ মুকুল আছে’! আমি বলেছিলাম, আপনার কাণ্ডজ্ঞানের অভাব আছে! যখন শীত বেশি হয় আর কুয়াশা ঘন হয়, তখন একটা মুকুল ঝরে না। লক্ষ লক্ষ মুকুলই ঝরে পড়ে!”

চাপের আবহেও স্বয়ং মুকুল অবশ্য চাপমুক্ত থাকারই চেষ্টা করেছেন। হাবরার মছলন্দপুরে এ দিন তাঁর রোড-শো’য় দলের নেতা-কর্মীদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। সন্ধ্যার মুখে গোবরডাঙা স্টেশনের কাছে জনসভায় পৌঁছে মুকুল শুরু থেকেই দলনেত্রীর প্রশংসা করেন। মমতাকে ‘আটপৌরে ঘরের মেয়ে’ বলে সম্বোধন করে তাঁর মন্তব্য, “১৯৮৪ সালের পরে কোনও রাষ্ট্রনায়ক পাহাড়ে যাওয়ার সাহস পাননি। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গিয়েছেন। সেখানে বলে এসেছেন, পাহাড় আমাদের রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যা জ্যোতি বসু, ইন্দিরা গাঁধীরাও বলতে সাহস পাননি।” রাজ্যের আর্থিক দৈন্যদশার মধ্যেও মুকুলের দাবি, “গত চার বছরে বাংলার জন্য যা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তা স্বাধীনতার পরে ভারতবর্ষের কোনও মুখ্যমন্ত্রী তা করতে পারেননি!”


গোবরডাঙায় ভোটের প্রচারে মুকুল রায় ও সাধন পাণ্ডে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

মুকুলের বক্তৃতায় মমতা-প্রশস্তির জেরে দলনেত্রীর সঙ্গে তাঁর একদা ‘নম্বর টু’র দূরত্ব কমবে কি না, তা নিয়ে যখন জল্পনা চলছে, তারই মধ্যে পৌঁছন মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। মুকুল বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে সাধনবাবুকে বলতে শোনা গিয়েছে, “ওরা (বিজেপি) সিবিআই লাাগিয়ে নেতা খুঁজছে। বলছে দল ভাঙো, বা চুপ করে যাও! চক্রান্ত আমরা বুঝে গিয়েছি। সাধারণ মানুষের কাছে আমরা বিচার চাইছি।”

দলের বাকিরা ‘চক্রান্ত’ বুঝে গেলেও তিনি যে কী বুঝেছেন, তা অবশ্য এ দিনও স্পষ্ট করেননি মুকুল!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement