তৃণমূল ভবনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে রয়েছেন দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন। —নিজস্ব চিত্র।
টিভিতে চোখ রেখে নাগাড়ে ফোনে খবর নিচ্ছিলেন। সামনে রাখা নোটপ্যাডে লিখে রাখছিলেন একের পর এক বুথের নম্বর। ঘনঘন চায়ে চুমুকের ফাঁকে অভিজ্ঞ নেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতার বুঝে নিচ্ছিলেন ভোটের হাল হকিকত।
কখনও খবর আসছে বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্র খারাপ। কখনও খবর পাচ্ছেন সকাল পেরিয়ে দুপুরেও শ্লথ ভোটের গতি। দ্রুত নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানাচ্ছেন। কখনও স্থানীয় কর্মীকে নির্দেশ পাঠাচ্ছেন। উপনির্বাচনের শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে তৃণমূল ভবনের ‘কন্ট্রোল রুম’ এ ভাবেই নিয়ন্ত্রিত হল হাফ শার্ট-ট্রাউজার্সে ‘যুবরাজে’র উপস্থিতিতে।
আগে থাকতেই ঠিক ছিল, সকাল ৯টার মধ্যে তৃণমূল ভবনে পৌঁছে যাবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের বেশ কিছু মন্ত্রী-সাংসদ-নেতাকেও বলে রেখেছিলেন সকাল সকাল ভবনে হাজিরা দিতে। ‘মুকুল-হীন’ তৃণমূল ভবনে সকাল থেকেই তাই অভিষেকের পাশে থেকে কন্ট্রোল রুমে সক্রিয় ছিলেন দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন। ভোটের উত্তাপ পোহাতে পোহাতে কখনও কন্ট্রোল রুমে ঢুকেছেন সাংসদ তথা দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী, মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, নেতা অলোক দাস, গায়ক-নেতা ইন্দ্রনীল সেন। তবু তারই মধ্যে অদৃশ্য বলয় কাজ করেছে যুবরাজকে ঘিরেই!
বনগাঁ লোকসভা ও কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা দুই কেন্দ্রের ভোট-হাওয়া বুঝতে যেখানেই একটু খটকা লেগেছে, অভিষেক পরামর্শ নিয়েছেন পার্থবাবু ও অরূপের। এর আগে ভোটের দিনে ভবনের এক তলায় যুব তৃণমূল সভাপতির কক্ষে চারটি এলসিডি টিভি স্ক্রিনে কখনও চোখ রাখতে হয়নি অভিষেককে। মুহূর্মুহূ ফোনও সামলাতে হয়নি। সে সব দায়িত্ব তখন থাকত দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের কাঁধে। এখন সে দিন গিয়েছে! নতুন অন্দর-সাজের তৃণমূল ভবনে ‘দায়িত্বে’ অভিজ্ঞ হতে এ বারই প্রথম কন্ট্রোল রুমে অভিষেক। স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে ‘অ-মুকুল’ বৃত্তে থাকা নেতাদের আনাগোনাই ছিল বেশি।
বনগাঁর অন্তর্গত বাগদায় পরপর কয়েকটি বুথের ভোটযন্ত্র খারাপের খবরে মাঝে একটু অস্বস্তি বেড়েছিল। অভিষেক যদিও স্মিতমুখে বলছিলেন, “কয়েকটা ইভিএম খারাপের খবর ছাড়া কোনও গোলমালের খবর তো পাচ্ছি না!” বেলা গড়াতে ভোটের হার বাড়ছে শুনে সে অস্বস্তি বদলেছে স্বস্তিতে। বেলা একটা নাগাদ শ্লথ ভোটের খবর পেয়ে সহনেতাদের সঙ্গে আলোচনায় যুবরাজ বলছিলেন, “দুপুরে শুক্রবারে নমাজ পড়ার জন্য ভোট হয়তো কম পড়ছে। একটু বিকেল হলে ভাল ভোট পড়বে।”
দুপুর দু’টো নাগাদ ভবন থেকে এক বারই বেরোলেন যুবরাজ। মিলন মেলায় মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তৃণমূল ভবনের চত্বরে তখন গুঞ্জন, অভিষেক কি তা হলে নবান্নে যাচ্ছেন পিসির কাছে? যুবরাজ আসলে ফিরেছিলেন বাড়ির পথে। স্নানাহার সারতে। ঘণ্টা দেড়েক পরে ফিরলেন ভেজা চুল, সকালের হাফশাটের্র বদলে হাতা- গোটানো ফুল শার্টে।
কন্ট্রোল রুম সামলানোর ফাঁকেই মাঝেমধ্যে নেতাদের নিয়ে দোতলার ঘরে গিয়ে আলোচনা সেরেছেন অভিষেক। ভোট-খবরের বাইরে সতীর্থদের নিয়ে কখনও আসন্ন পুরভোট, কখনও দলের সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনা সেরেছেন মহাসচিব পার্থবাবুও। বিকেল ৫টা বাজার আগেই দু’কেন্দ্রেই ৭০%-এর উপরে ভোট পড়েছে জেনে কন্ট্রোল রুমে স্বস্তির আবহ এল ঠিকই। দু’কেন্দ্রেই জয় নিশ্চিত বলে আত্মবিশ্বাসী সুরও শোনা গেল তৃণমূল নেতাদের গলায়। কিন্তু অন্যান্য ভোটের দিনে কন্ট্রোল রুমে হাজির নেতা-মন্ত্রীদের আলাপচারিতা, শরীরী ভাষায় যে টগবগে ভাব থাকে, এ দিন তার কিছুই যেন ছিল না! বহিরঙ্গে দিনভরই নিস্তরঙ্গ ভাব!
দিনশেষে ভোট-পরিচালনে যুবরাজের অভিষেকে প্রত্যাশিত ভাবেই প্রশংসা এসেছে নেতা-মন্ত্রীদের তরফে। পার্থবাবু তো বলেই ফেললেন, “এ বার অভিষেকের নেতৃত্বে যুব তৃণমূল মূল তৃণমূলের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে সঙ্গত করে জোরদার প্রচার করেছে। অভিষেক অসীম দক্ষতায় ভোটের দায়িত্ব সামলেছে!” আগামী দিনের আরও দায়িত্ব বুঝে নিতে তাই হয়তো বিকেল ৫টা নাগাদ পার্থবাবুর সাংবাদিক বৈঠকে বক্তার সারিতে না থেকে অভিষেক দাঁড়ালেন দর্শকের ভিড়ে। হয়তো পার্থবাবুর বক্তব্য শুনে ঝালিয়ে নিলেন ভোটের দিনে সাংবাদিক সম্মেলনের কৌশল!