নজর ‘নিষিদ্ধ’ কাগজে। শুক্রবার নয়াদিল্লিতে সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে মুকুল রায়। ছবি: ইয়াসির ইকবাল।
সম্পর্ক বদলায়। বদলায় ঠিকানাও!
১৮১, সাউথ অ্যাভিনিউ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লির ঠিকানা। দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রীর অস্থায়ী দফতর। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন, অণ্ণা হজারে পর্ব, দিল্লিতে কর্মরত আমলাদের নৈশভোজ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী সাউথ অ্যাভিনিউয়ের এই বাড়ি। কিন্তু সম্পর্কের তিক্ততায়, সেই ঠিকানা বদলে গেল আজ থেকে।
মুকুল রায়ের নামে বরাদ্দ হওয়া ওই বাড়ির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক আজ থেকে ছিন্ন করে দিলেন তৃণমূল নেত্রী! তাঁর সঙ্গে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তাতে সিলমোহর দিতেই আজ একেবারে সংবাদমাধ্যমকে ডেকে পাঠিয়ে সকলের চোখের সামনে ওই বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলা হল মমতার ব্যক্তিগত জিনিস, আসবাবপত্র সব কিছু। মুকুলের বাড়ি থেকে মুছে ফেলা হল মমতার সমস্ত চিহ্ন। তৃণমূল সূত্রে জানানো হয়েছে, ১৮১ সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে এখন আর মমতার কোনও ব্যক্তিগত বা সরকারি জিনিসপত্র নেই। মুকুল রায় তথা দিল্লিতে দলের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত ওই বাড়ি থেকে তাঁর যাবতীয় জিনিস সরিয়ে ফেলা হয়েছে পাশের ১৮৩ নম্বর বাংলোয়। ঘটনাচক্রে যেটি তৃণমূলে মুকুলের উত্তরসূরি তথা দলনেত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লির ঠিকানা। কিছু মালপত্র গিয়েছে দোতলায় ১৮৪ নম্বর ফ্ল্যাটে, যেটিতে থাকেন তৃণমূলেরই ডেরেক ও’ব্রায়েন।
সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে সিবিআই মুকুল রায়কে ডেকে পাঠানোর পর থেকেই তাঁর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দূরত্ব বাড়তে শুরু করে। গোয়েন্দা সূত্রে ইঙ্গিত মেলে, প্রথম দিন জেরার মুখেই মুকুল সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে এমন অনেক তথ্য দিয়েছেন, যা তৃণমূল নেত্রীর অস্বস্তির কারণ হতে পারে। এর পরেই দলে মুকুলের ডানা ছাঁটার প্রক্রিয়া শুরু দেন মমতা। মুকুল যে দলে অপাংক্তেয়, তা গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন ভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা-সহ দলের অন্য নেতারা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনও দল ছাড়ার উদ্যোগ বা দলবিরোধী কোনও কাজ করেননি মুকুল। অথচ তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব চাইছেন, নিজেই সরে যান মুকুল। তা না হওয়ায় এ বার এই চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর পথ নেয় দল! ঠিক হয়, সরানোর সময় ডাকা হবে সংবাদমাধ্যমকে। যাতে তারা বিষয়টি সরাসরি সম্প্রচার করতে পারে। এ নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে মৃদু মতপার্থক্য হলেও ততক্ষণে ভিড় জমিয়েছে সংবাদমাধ্যম। এবং সকলের চোখের সামনেই সরানো হয় মমতার সমস্ত মালপত্র।
১৮১ থেকে মাল যাবে ১৮৩-তে। দুই বাড়ির খিড়কির দরজাও মুখোমুখি। ফলে বিশেষ পরিশ্রম করতে হয়নি মজুরদের। প্রথমেই বাড়ি থেকে কাগজপত্র, ফাইল সরানো হল। তার পরে গেল মমতার ছবি। এর পর ট্রেডমিল। দিল্লি এলে যন্ত্রটিতে অন্তত এক ঘণ্টা সময় কাটাতেন মমতা। মাঝে সামান্য বিরতি দিয়ে একে একে আলমারি, খাট, বসার টেবিলের মতো বড়সড় মালপত্র। বেলা তিনটে নাগাদ ১৮১ সাউথ অ্যাভিনিউ থেকে মমতার উপস্থিতি মুছে গেল!
দুই বাংলোর মধ্যে দূরত্ব মাত্র ফুট পাঁচেক। কিন্তু দু’পক্ষে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা পার হওয়া অসম্ভব বলেই মেনে নিচ্ছেন মমতা ঘনিষ্ঠেরা। কারণ মমতা আজ যে কড়া বার্তা দিলেন, তা থেকে স্পষ্ট, বরাবরের ছায়াসঙ্গী মুকুলের সমস্ত সংস্রব এড়িয়ে চলতে তিনি বদ্ধপরিকর। সে কারণেই মুকুলের নামে বরাদ্দ হওয়া বাড়িও আজ থেকে ব্রাত্য হয়ে গেল মমতার কাছে!
প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে লোকসভায় তৃণমূলের সাংসদ মাত্রই এক, খোদ দলনেত্রী। তখন তাঁর ঠিকানা বিশ্বম্ভরদাস রোডের এমপি ফ্ল্যাট। তিন তলার তিনটি ফ্ল্যাটের একটিতে থাকতেন মমতা নিজে। পাশের ভাড়ায় নেওয়া ফ্ল্যাটটিই তখন মুকুল রায়ের ঠিকানা। পরে রাজ্যসভার সাংসদ হয়ে ওই ফ্ল্যাটটি নিজের নামে বরাদ্দ করিয়ে নেন তিনি। রেলমন্ত্রী হওয়ার সময়টুকু ওই ফ্ল্যাটেই কাটিয়েছেন মমতা। বাংলো প্রাপ্য হলেও তা নেননি।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে সাংসদ পদ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওই ফ্ল্যাটটিও ছেড়ে দেন মমতা। তত দিনে দল বেড়েছে। সংসদে শক্তিবৃদ্ধি শুধু নয়, সরকারের শরিক হিসেবেও রয়েছে দল। ১৮১, সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাড়িটি বরাদ্দ হয় দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের নামে। এ দিকে দিল্লিতে দলের কার্যালয়ের অভাব। তাই ওই বাড়িটিকেই দলীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। ঠিক হয়, মমতা দিল্লি এলে ওই বাড়িতে উঠবেন। মুকুল চলে যান ১৪১ নম্বর সাউথ অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে, যা আপাতত ভাড়ায় নেওয়া রয়েছে।
শুক্রবার যখন মাল সরানোর কাজ চলছে, তখন দু’বাড়ির সকলেরই মুখ ছিল গম্ভীর। মুকুলের বাংলোর গেটে বেশ ক’বছর পাহারায় রয়েছেন আধা সামরিক বাহিনীর এক নিরাপত্তাকর্মী। দিনভর কাজ সেরে শ্রমিকেরা ফিরে গেলে ম্লান মুখে বলে উঠলেন, “স্যার, রাজনীতি বড় খারাপ জিনিস। বন্ধুও কবে শত্রু হয়ে যায়, কেউ জানে না!”