রক্ত, রক্ত এবং রক্ত! গত ৬ বছর ধরে শুধুই রক্তক্ষরণ চলছে ভোটব্যাঙ্কে। কয়েক মাস আগে লোকসভা ভোটে নজিরবিহীন বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলে মিছিল-জমায়েতে আবার লোক টানা শুরু হয়েছে। কিন্তু ভোটের বাক্সে তার কোনও প্রতিফলন নেই! জোড়া উপনির্বাচনে ফের রক্তপাত দেখে এখন ধাঁধায় পড়েছে আলিমুদ্দিন।
লোকসভা ভোটে ভরাডুবির পরে গত সেপ্টেম্বরে বসিরহাট দক্ষিণ ও চৌরঙ্গি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনেও বিশ্রী ভাবে ধরাশায়ী হয়েছিল বামেরা। ভোটে লাগাতার এমন বিপর্যয় হলে দলের নেতা থেকে সমর্থক, সব মহলে হতাশা আসতে বাধ্য। তবু নৈরাশ্য কাটাতে চেয়ে নানা দাবি নিয়ে এবং সম্মেলন-পর্বকে উপলক্ষ করে পথে নামা শুরু হয়েছিল। তাতে সাড়াও মিলছিল ভাল। এরই মধ্যে আবার নতুন ধাক্কা নিয়ে হাজির বনগাঁ ও কৃষ্ণগঞ্জের উপনির্বাচন! এটা ঘটনা যে, এই উপনির্বাচনে বামেদের ফল বসিরহাট বা চৌরঙ্গির তুলনায় একটু ভাল। এ বার দুই এলাকা মিলে মোট ৮টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৪টিতে দ্বিতীয় হয়েছে বাম, বিজেপিও সমসংখ্যক কেন্দ্রে দ্বিতীয়। কিন্তু ভোট-বাক্সে ভাঙন বন্ধ হওয়ার ইঙ্গিত নেই।
এখনই ঘুরে দাঁড়িয়ে তৃণমূলকে কুপোকাৎ করে দেওয়ার মতো জায়গায় তাঁরা পৌঁছে গিয়েছেন, এমন আশা সিপিএমের জেলা বা রাজ্য স্তরের কোনও নেতাই করেননি। কিন্তু এ বার তাঁদের ভাবিয়ে তুলছে আরও একটি তথ্য। সারদা-কাণ্ড থেকে শুরু করে তৃণমূলের সরকারের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভের উপকরণ থাকা সত্ত্বেও এ বারের উপনির্বাচনে বিরোধীদের ভোট বাড়েনি। বামেদের বাক্স থেকে ভোটের বেশ কিছু অংশ বিজেপির দিকে গিয়ে দ্বিতীয়-তৃতীয় স্থানের মধ্যে দড়ি টানাটানি হয়েছে। কিন্তু প্রথম স্থানে থেকে তৃণমূল তাদের ভোট ধরে রাখতে পেরেছে। সিপিএমের মধ্যেই এখন প্রশ্ন, তা হলে কি লোকে শুধু তাদের কথা শুনতেই আসছে? ভোট দিচ্ছে না! বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইনিংসের প্রথম দিকে যেমন হতো?
এই প্রশ্নেও আবার সিপিএমের মধ্যে দু’রকম ব্যাখ্যা উঠে আসছে। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের মতে, “লোকসভা ভোটের পরে স্বাভাবিক ভাবেই কর্মী-সমর্থক মহলে চরম হতাশা এসেছিল। সেটা কাটিয়ে এখন আবার মিছিল-সমাবেশে লোক আসছে। তারা কিন্তু ভোটও দিয়েছে। কিন্তু ভোট তো শুধু কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে হয় না। এর বাইরে আমরা এখনও নিজেদের নিয়ে যেতে পারিনি।” আবার রাজ্য নেতৃত্বেরই অন্য এক অংশের বক্তব্য, ভিড় জমাতে যে জনতা আসছে, তাদের সকলে ভোট দিচ্ছে না। প্রতিবাদের কথা শুনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু ভোট দেওয়ার মতো আস্থা রাখতে পারছেন না।
সিপিএমের অন্দরে ধাঁধার উত্তর খোঁজা চললেও বিরোধী রাজনীতির পরিসরে সকলে অবশ্য এখনই বামেদের মৃত্যুর শংসাপত্র লিখে দিতে নারাজ। অবিরত রক্তক্ষরণ সত্ত্বেও ভোটের কিছু ভাগ ধরে রেখেছে বামেরা। এটাকে একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশও। তৃণমূল যেমন রাজ্যের শাসক দল হিসেবে বাড়তি কিছু সুবিধা পাচ্ছে, পুলিশ-প্রশাসন তাদের পাশে রয়েছে, বিজেপি আবার তেমনই কেন্দ্রের শাসক দল। এ সবের কোনও সুবিধাই এখন বামেদের দিকে নেই। সংবাদমাধ্যমের প্রচারেও অনেক বেশি জায়গা নিয়ে বিজেপি। এত সবের মধ্যেও বনগাঁয় সিপিএম প্রার্থী দেবেশ দাস যে ভাবে সওয়া তিন লাখের বেশি ভোট পেয়েছেন, তাকে একেবারে ধর্তব্যের বাইরে রাখতে চাইছে না শাসক ও বিরোধী, উভয় শিবিরেরই অনেক নেতা। বিজেপির এক নেতার কথায়, “কেন্দ্রে ক্ষমতা হারানোর আট মাসের মধ্যে সারা দেশে কংগ্রেস প্রায় নিশ্চিহ্ন। বামেরা কিন্তু এত রক্তক্ষরণের পরেও বনগাঁয় ২৬% ভোট পেয়েছে!”
আলিমুদ্দিন বুঝতে পারছে, রক্তক্ষরণের স্রোতে বাঁধ দিতে না পারলে ওই ভোটও ধরে রাখা মুশকিল। তাদের বিশ্লেষণ, বামেদের সংখ্যালঘু ভোটের একাংশ নিরাপত্তার আশায় তৃণমূলের দিকে গিয়েছে। আবার সংখ্যাগুরু ভোটের একটা অংশ চলে যাচ্ছে বিজেপির দিকে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর মতে, বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৃণমূলও বিভাজনের রাজনীতি করছে। এই ‘ককটেল’-এর কাছে বামপন্থীরা পরাজিত হচ্ছে। তৃণমূল-বিজেপি কেউ কারও বিকল্প নয়, মানুষ এটা উপলব্ধি করার আগে পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলবে বলেও কবুল করেছেন বিমানবাবু।
এই অবস্থায় সিপিএম আপাতত মন দিয়েছে সাংগঠনিক রদবদলের দিকে। বাঁকুড়ায় অমিয় পাত্র, পশ্চিম মেদিনীপুরে দীপক সরকার বা বর্ধমানে অমল হালদার আর সম্পাদক নন এমন সিপিএমকে জেলায় জেলায় এ বার বহু দিন পরে দেখবেন মানুষ। রাজ্য সম্পাদক পদেও পরিবর্তন আসন্ন। দলের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য বলতে শুরু করেছিলেন, সূর্যকান্ত মিশ্রের মতো নেতাকে রেখে দেওয়া হোক ভবিষ্যতে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরার জন্য। রাজ্য সম্পাদক হোন অন্য কেউ। কিন্তু দুই উপনির্বাচনের ফল দেখে আবার পাল্টা যুক্তি জোরালো হয়েছে, আগে দল বাঁচলে তবেই না সরকারের স্বপ্ন!
হতাশা চেপে রেখেই আপাতত ৮ মার্চের সমাবেশে ব্রিগেড ভরানোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয়বাবু যদিও বলছেন, “উপনির্বাচনে শাসক দলকে একটুও নড়ানো যাবে না বুঝেই মানুষ বিরোধীদের ভোট দেননি। সাধারণ নির্বাচনেও এই জিনিসই হবে বলে মনে হয় না।” তবু দলের মধ্যেই প্রশ্ন থাকছে, ব্রিগেড ভরানোর পরেও যে ভোটে একই পরিণতি হবে না, তার নিশ্চয়তা কী? স্থানীয় স্তরে আন্দোলনের পাশাপাশি প্রচারে আরও আক্রমণাত্মক হওয়ারর দাবি উঠছে দলেই।
গোটা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী দলের বর্ধমান জেলা সম্মেলনে গিয়ে যা বলেছেন, তার সঙ্গেই একমত হচ্ছেন বামফ্রন্টের বড় অংশ। শ্যামলবাবুর মতে, তাঁরা সুযোগ তৈরি করছেন প্রচুর। কিন্তু সেগুলো থেকে গোল হচ্ছে না! সুযোগকে গোলে পরিণত করাই আন্দোলনের প্রকৃত সাফল্য। সেই কাজ দক্ষ স্ট্রাইকারের। যে বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত হয়েই ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য নেতা হাফিজ আলম সৈরানি বলছেন, “প্রতিবাদের বিষয় পেয়ে শুধু মিটিং-মিছিল করলেই হল না। আরও আক্রমণাত্মক হতে হবে। প্রশাসনকে বাধ্য করতে হবে কথা শুনতে।”